শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন প্রজন্মের ভাবনা

শাহ মুজতবা রশীদ আল কামাল
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০২২
  • ৪৫৭ Time View

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে গৌরবজনক অধ্যায় হিসেবে। কারণ বাঙালি জাতি জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে। অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে, কখনো মোগল-পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনোবা পাকিস্তানিদের দ্বারা জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাস মানেই না পাওয়া আর বেদনার ইতিহাস।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরের ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম এবং ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর।

বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করেছেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন করা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ছবি, নাটক এগুলো আরো বেশি করে প্রচার করা দরকার। আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দরকার যে, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যে জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেশ, মাতা ও মাতৃভূমিকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কারা সেই চেতনা ধারন করেছে তা জানতে হবে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জনকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল, এগুলো নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদর আল শামস বাহিনী কিভাবে এদেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, শ্রমজীবী, কৃষকসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানি করেছে মা-বোনদের, অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজ করেছে তার যথাযথ ইতিহাস নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব ও কর্তব্য সবারই। কিন্তু আমরা সেটি কতটুকু করছি এবং করতে পেরেছি সেই প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বিশে^র মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একটি ভূখন্ডের, যার নামবাংলাদেশ।

সবুজের জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত মানেিচত্রের এ দেশটির ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণ করছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছর তথা সুবর্ণজয়ন্তী এই পথচলায়  দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার পর তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ আখ্যা দিয়ে যারা অপমান অপদস্থ করেছিল সেই তাদের কন্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। দারিদ্র আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তোরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি আসবে খুব শীঘ্রই। এটা নিঃসন্দেহে একটি মর্যাদার বিষয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক দিয়ে অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন সামনের কাতারে। এছাড়াও বিদ্যুৎখাত, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, জ¦ালানীখাত এবং শিল্পখাতের উন্নয়নও চোখেপড়ার মতো। তবে কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যেমনঃ দুর্নীতিমুক্ত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা, বেকার সমস্যা, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন প্রজন্ম প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সুখী সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। যে দেশে থাকবে মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, মানবাধিকার রক্ষা, মেধার ভিত্তিতে মানব সম্পদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, তথ্য প্রযুক্তির আধুনিকায়ন ও অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ।

আমরা অনেক ভাগ্যবান এ জন্যই যে, বঙ্গবন্ধুর মত একজন বিশ^মানের নেতা আমাদের মাঝে জন্মে ছিলেন বলে। যিনি নিজের সুখ দুঃখের কথা কখনোই ভাবেননি। ভেবেছেন এ দেশের সাধারণ মানুষের কথা, কিভাবে তাদের অধিকার আদায় করা যায়, কিভাবে তাদের শোষনের হাত থেকে রক্ষা করা যায় ভেবেছেন সে কথা।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেযিনি মহানায়কের ভূমিকা পালন করেছেন, তিনিই হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়। ইতিহাসের চাকাকে উল্টোরথে ঘোরানো হয়। সময়ের পরিক্রমায় আজ সত্য ইতিহাস সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জয়বাংলা শ্লোগানকে আমাদের জাতীয় শ্লোগান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এর ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ^ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের প্রচলিত আইনে বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আসামিদের মধ্যে কয়েকজনের ফাঁসীর রায় কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে এবং মোটাদাগী যুদ্ধাপরাধীদের ইতিমধ্যেই ফাঁসীর রায় কার্যকর হয়েছে। অনেক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রয়েছে।

নতুন প্রজন্ম মনে করে এখন সঠিক পথেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, কারণ বিজয় মানে শুধু একটি পতাকা বা ভূখন্ড নয়। অর্থনৈতিক মুক্তির পথে দেশ এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ বিশে^র কাছে এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আমাদের নিজেদের অর্থায়নে আজ দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু। মেট্রোরেল, কর্ণফুলি নদীতে টানেল নির্মাণসহ যেসব মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে তা উন্নয়নের পথে যুগান্তসৃষ্টিকারী পদক্ষেপ।

নতুন প্রজন্ম মনে করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণসহ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ ও স্মৃতি জাদুঘর তৃণমূল পর্যায়ে  নির্মাণ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা দীর্ঘ ৫০ বছর পর সুবর্ণজয়ন্তীর মাধ্যমে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। মানুষের জীবন মানের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্মশতবর্ষে নতুন প্রজন্ম মনে করে মুজিব আদর্শে উজ্জীবিত হোক সারা বাংলা। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্মগ্রহণ করুক মুজিবের মতো ন্যায়-নিষ্ঠা , আদর্শবান, সত্যবাদী, নিরহংকারী সাহসী নেতা। বঙ্গবন্ধু যেমন ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছের সকল অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতিকে তেমনি সকলেই অন্যায়, অবিচারও দুর্নীতিকে প্রত্যাখান করে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত সোনার বাংলা বিনির্মাণ করবে।

বাংলাদেশ বিশে^র বুকে মাথা উচুঁ করে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে থাকবে এটাই হোক সকলের অঙ্গীকার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাই হোক সকলের ভাবনা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com