শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:০৮ পূর্বাহ্ন

বঙ্গনেতা

॥ প্রফেসর হোসনেয়ারা খাতুন ॥
  • Update Time : বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০২২
  • ৪৯১ Time View

তিনি আসলেন, দেখলেন, শুনলেন এবং বুঝলেন: তারপর জয় করলেন। হঠাৎ করে জয় করা যায় না। জয়ের পেছনে প্রচুর সাধনা করতে হয়, ত্যাগ করতে হয়, কষ্ট করতে হয়। বছরের পর বছর পায়ে হেঁটে পায়ের তলা ক্ষয় করে তবেই না জয় ছিনিয়ে আনা যায়। তেমনি একজন এসেছিলেন এই বাংলায়। যাঁর জন্য বঙ্গভূমির পর পূর্বপাকিস্তান হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যাঁর জন্য এত বড় প্রাপ্তি বাঙালির ভাগ্যে ঘটেছে, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু বঙ্গনেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ শতকের ত্রিশের দশকের কথা। তখন ইংরেজ শাসনের শেষ পরিণতি এগিয়ে এসেছে। বিভিন্নভাবে ছোটো ছোটো সাংগঠনিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বিশাল মেঘমালায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় বজ্রপাতের সম্ভাবনা আছে। বনেদী জমিদারশ্রেণীর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা চরমে উঠেছে এবং নব্য জমিদারদের ইংরেজপ্রীতি ও প্রজার উপর অপশাসনের পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রদায়গত রেষারেষি চরম পর্যায়ে। শ্রেণিবিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষার অব্যবস্থা এপার বাংলায় সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছিলো। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববাংলার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে সেই মহান নেতার জন্ম হয়।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে সিরাজ-উদ্্-দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীন সূর্যের ভরাডুবি হয়েছিল। সেই থেকে ভারতবর্ষসহ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা গৌড়ভূমি পরাধীনতার করালগ্রাসে নিমজ্জিত। এরপর বহু বছর কেটে গেলো বাংলা তিমিরেই রয়ে গেলো। সিপাহী বিদ্রোহ, স্বদেশী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, কৃষক আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বর্তমানে নেতাজী সুভাষ বসুতে এসে পৌঁছেছে। ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলন চরম আকার নিয়েছে। এর মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিকল হয়ে যাচ্ছে। এই বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যে মধুমতী নদীর তীরে অবস্থিত গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। এই গ্রামেরই শেখ বংশ, যাঁরা বর্তমানে মধ্যবিত্ত পরিবারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এক সময় এই শেখ পরিবার জমিদার শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। শোনা যায় শেখ বোরহান উদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের পত্তন করেছিলেন বহুকাল পূর্বে। এই সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশ দখল করে এবং কলকাতা বন্দর গড়ে তোলে।

ইংরেজরা মুসলমানদের ভালো চোখে দেখতে পারতো না। হিন্দু জমিদারগণ ইংরেজদের সহযোগী শক্তি হয়ে মুসলিম জমিদারদের ক্ষতির চেষ্টা করতে থাকে। পূর্ববাংলা পশ্চিম বাংলার ন্যায় সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে সমগোত্রীয় ছিলো না বরং অনেকখানি পিছিয়ে ছিলো। ফলে পূর্ববাংলার জনগণের মনন-মানস ছিলো পিছিয়ে। টালমাটাল রাজনৈতিক অস্থিরতার এই অন্ধকারে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে সায়েরা খাতুনের কোল জুড়ে বাংলার অস্তমিত সূর্য পূর্বাচলে উষালগ্নের লাল সূর্যের ন্যায় উদিত হলো। তীব্র চিৎকারে জানিয়ে দিলেন আমি এসেছি বাংলার ঘনঘটাকে মোচন করতে।

ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের অর্থসংকট থাকলেও ইংরেজ বিরোধিতা ছিলো অবিচল। শিক্ষার অভাবে পূর্ববাংলার মুসলিম পরিবারগুলো ভেঙে বিভাজিত হতে হতে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেলো। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগলো। শুধু তাই নয়, এই অবস্থার কবল থেকে শেখ পরিবারও বাদ পড়লো না। পরাধীন বাঙালির অস্তমিত সূর্যের নবোদয় হলো যার মধ্যে সেই ছেলেটির নাম রাখা হলো শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমান সাংসারিক অভাব দূর করার জন্য চাকরির চেষ্টা করতে লাগলেন। তখন মুসলমানদের চাকরি পাওয়া দুষ্কর ছিলো। তবুও দেওয়ানি আদালতে একটা চাকরি পেয়ে পরে সেরেস্তাদার হয়েছিলেন। শেখ মুজিব যখন ম্যাট্রিক পাস করেন তখন তাঁর আব্বা চাকরি শেষ করে পেনশনে গমন করেন। এদিকে মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। বাবা মা আদর করে তাঁদের সন্তানকে ‘খোকা’ নামেই ডাকতেন। ছেলেবেলায় তাঁদের ‘খোকা’ বেশ রোগা প্রকৃতির ছিলেন। খোকাকে সুস্থ রাখার জন্য মায়ের আপ্রাণ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তিনি খুব একটা সুস্থ থাকতেন না। পারিবারিক সম্পর্কের কারণে সমাজে প্রচলিত বাল্য বিয়ের কবলে নিমজ্জিত হতে হলো তাঁকে। তাঁর বয়স যখন বারো বা তেরো তখন তাঁর আব্বার চাচার নাতনীর সাথে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। শুধু বিয়ের প্রস্তাব নয় সাথে সাথে বিয়েও দিয়ে দেন। তখন বঙ্গমাতার বয়স তিন বছর। বঙ্গমাতার ডাকনাম রেণু। রেণুর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন রেণুর মা মারা যান। সাত বছর বয়সে নানাও মারা যান। এরপর থেকে রেণুও শেখ পরিবারে মুজিবের মায়ের নিকটই বড় হন। বাবা শেখ লুৎফর রহমানের সাথে মা সায়েরা খাতুন কখনো শহরে থাকেননি। কিশোর শেখ মুজিব কয়েকবার চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন মুজিব ভীষণভাবে বেরিবেরি রোগে আক্তান্ত হন। ফলে হার্ট দুর্বল হয়ে প্রায় দুবছর চিকিৎসাধীন ছিলেন। দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও বাল্য বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন ধরণের খেলা করতেন, গান গাইতেন। শুধু খেলা বা গান নয়, একনিষ্ঠভাবে ব্রতচারীও ছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার অসুস্থ হন এবং প্রচণ্ড খারাপ অবস্থা হয়। এই ধাক্কায় তাঁর চোখ খারাপ হয়ে যায় এবং দুটো চোখই অপারেশন করেন। এই বয়স থেকেই তিনি চশমা ব্যবহার করেন। চোখের চিকিৎসার পর মাদারিপুরে ফিরে এসে তিনি বিশ্রামে থাকেন। বিশ্রামের মাঝে তাঁর একটাই কাজ ছিলো জনসভায় যোগ দেওয়া। তখন চলছে স্বদেশি আন্দোলন। স্বদেশি আন্দোলনের হাওয়া মাদারিপুরের ঘরে ঘরে বইছে এবং স্থানীয় নেতা হিসেবে পূর্ণদাস তখন ইংরেজদের আতঙ্ক ছিলেন। এছাড়াও মাদারিপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত। পনের-ষোল বছরের ছেলেরাই সাধারণত স্বদেশি আন্দোলনের সদস্য হতেন। স্বদেশি আন্দোলন তথা সুভাষ বোসের অভয়ারণ্য মাদারিপুরের বাসিন্দা হওয়ার সৌভাগ্য এবং সুভাষ বোসের রাজনৈতিক আদর্শে থেকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক মানস সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। তিনি আস্তে আস্তে ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন এবং সুভাষ বসুর ভক্ততে পরিণত হন।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিব আবার পড়ালেখা শুরু করলেন এবং গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে ভর্তি হন। শেখ মুজিবের জন্য নিয়োগ দেওয়া জায়গির মাস্টারের পরিচালনায় ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ নামে সংগঠনের হয়ে শেখ মুজিব প্রত্যেক রবিবার দলবল নিয়ে থলে হাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন এবং সেই চাল বিক্রির টাকা দিয়ে গরীব ছেলেদের পরীক্ষার ফি ও বই ক্রয় করে সাহায্য করতেন। জায়গির মাস্টারের মৃত্যুর পর ঐ সমিতির ভার গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। কিশোর মুজিবের এই সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে একজন দরদিমনের মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়। সংবেদনশীল মনের অধিকারী না হলে এমন নিঃস্বার্থ ত্যাগ করা যায় না। অদম্য মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন বলে এক টুকরো লোহা পেলে সেটাকে মূল্যবান রত্নের রূপ দিতে পারতেন। তার পরিচয় মেলে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র অগ্রগমনে।

বাড়িতে শেখ মুজিবের বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পাওয়াই বলে দেয় তিনি কতখানি অগ্রবর্তী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক মানস গড়ে উঠা এবং দেশ-মাটি-মা মানুষের প্রতি প্রেমময় হৃদয় জাগ্রত হওয়ার মূল শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি দেশের সার্বিক খবরাখবর জানতে পারতেন। ফলে তাঁর চিন্তাশক্তি আরো প্রখর হতে লাগলো। ব্যক্তি জীবনে শেখ মুজিব ছিলেন একগুঁয়ে বা একরোখা। তাঁর একটা দল ছিলো। দলের মধ্যে শেখ মুজিব বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ায় দলের প্রধান ছিলেন এবং দলের কাউকে কেউ কিছু বললে তিনি রক্ষক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। মারপিট করতেন, প্রতিবাদ করতেন। শেখ মুজিবের এসকল কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায়ই তাঁর আব্বার নিকট নালিশ আসতো এবং তিনি অতিষ্ঠ হয়ে পড়তেন। শুধু বিরক্তই হতেন তা নয়, বুকে আগলে ছেলেকে রক্ষাও করতেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শের-এ-বাংলা এবং শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এই দুই নেতার আগমন উপলক্ষ্যে সমস্ত ব্যবস্থা আয়োজনের ভার পড়লো শেখ মুজিবের উপর। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে হিন্দু ছাত্রদের চলে যাওয়া দেখে শেখ মুজিব অবাক হয়েছিলেন। পরে বুঝলেন কংগ্রেস মুসলিম সম্মেলনে হিন্দুদের যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। হিন্দু মুসলিম বিভাজন ব্যাপারই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী শেখ মুজিবের নিকট অজানা ছিলো। কারণ তিনি সম্প্রদায়গত বিভাজন বিশ^াস করতেন না। এভাবে ছোটো ছোটো সাংগঠনিক কাজকর্ম থেকেই তিনি একজন কঠোর রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিব যে স্কুলে পড়ালেখা করতেন সেই মিশন স্কুল পরিদর্শনে যান। সেখানে তিনি শেখ মুজিবকে নিকট থেকে বুঝতে চেষ্টা করলেন। তখন থেকেই শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য হয়ে উঠলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে ‘মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলীম লীগ’ গঠন করার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব মতে ‘মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয় এবং মুসলিম লীগের সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এরপর ‘মুসলিম লীগ’‘ডিফেন্স কমিটি’ গঠন করে এবং তার সেক্রেটারিও বানানো হলো শেখ মুজিবকে। টুঙ্গিপাড়ার সেই উদীয়মান সূর্য ক্রমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আস্তে আস্তে উজ্জ¦ল হতে লাগলেন।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পাস করেন। এই বয়সেই জনদরদি নেতা মুজিব পাকিস্তান কায়েম করার স্বপ্নে বা মুসলমানদের বাচাঁনোর স্বপ্নে অন্যান্য বড় নেতাদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। মুসলিম ছাত্রলীগের অঙ্গসংগঠন খোলা হলো মাদারিপুরে। তারপরই ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স এর আয়োজন করা হয়। সেখানে দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গের আমন্ত্রণ ছিলো। যেমন- কবি কাজী নজরুল, হুমায়ুন কবীর, ইব্রাহীম খাঁ প্রমুখ। রাজনীতির পাশাপাশি এই সমস্ত সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গের সাহচর্যে এসে মানবিক মুজিব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। ইসলামিয়া কলেজকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। এরপর থেকে ছাত্রলীগের নির্বাচনে শেখ মুজিব অজেয় থেকেছেন। এভাবেই পূর্বাচলে উষালগ্নের লাল নিরুত্তাপ সূর্য মধ্যাহ্নের গনগনে উত্তপ্ত সূর্য হয়ে ওঠেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব।

১৯৪৩ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুতে জনদরদী নেতা শেখ মুজিবের হৃদয় কেঁদে ওঠে। দুর্ভিক্ষপীড়িত রুগ্ন সময়েই তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য হন। দুর্ভিক্ষের প্রাবল্য দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লো। সংবেদনশীল মননের অধিকারী শেখ মুজিব তাঁর দলবলের সমন্বয়ে হোস্টেলের বাড়তি খাবারটুকু তুলে দিতে লাগলেন অনাহারী মানুষদের মুখে। যা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। এই অবস্থায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। শেখ মুজিব লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাপিয়ে পড়লেন। এছাড়াও রিলিফের কাজ করার জন্য তিনি কলকাতা থেকে গোপালগঞ্জে ফিরে আসেন। পূর্ববাংলায় দুর্ভিক্ষের চূড়ান্ত পর্যায় দেখে তিনি তাদের সাহায্যের জন্য একটি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন নেতৃবৃন্দকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব আবার কলকাতা গেলেন। এ সমস্ত সেবামূলক কাজের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধিতা করার মানুষের অভাব ছিলো না। তা সত্ত্বেও শক্তিশালী নেতাবৃন্দের স্নেহের হাতই তাঁর শক্তির আঁধার ছিলো। যেমন শের-এ বাংলা, সোহরাওয়াদী, খাজা নাজিমুদ্দীন, তমিজুদ্দিন খান, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমূখ। এই তালিকা থেকেই বোঝা যায় যেমন পাত্র তেমন ব¯ু‘। কিম্বা “সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার”। তৎকালীন নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিতে শেখ মুজিব একজন যোগ্য ও ভালো কর্মী ছিলেন। দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে আয়োজিত কনফারেন্সের বাস্তবতা শেখ মুজিবের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। সংগঠনের কাজ বা দায়িত্ব পালনকালে শেখ মুজিব বিভিন্ন ধরনের বিপদে পড়তেন এবং সকল বিপদ থেকে বাবাই তাঁকে বটবৃক্ষের মত ছায়া হয়ে আগলে রাখতেন। জনসেবামূলক কাজের উৎসাহদাতা ছিলেন মূলত শেখ মুজিবের বাবা। কথায় বলে ‘যেমন বাপ, তেমন পো’।

১৯৪৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এই সংগঠনের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন মুজিব। সামাজিক ও রাজনীতিক এহেন পরিস্থিতিতে গ্রীষ্মের আকাশে বেড়ে উঠা গনগনে সূর্য মধ্যাহ্নের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন। সেই এগিয়ে চলার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপাকিস্তানের দল হিসেবে গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। এরপর গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ’। অতুলনীয় দক্ষতার গুনে এই সংগঠনে জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। এই ‘আওয়ামী মুসলিমলীগ’ ই পরবর্তীতে শুধু ‘আওয়ামীলীগ’ নামে যাত্রা শুরু করে। সংগঠনের দায়িত্ব পাওয়ার পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত সময়ে এই অদম্য নেতা তিনবার জেল খেটেছেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবারও জেলে যান। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি জেলে ছিলেন এবং জেলে বসে তিনি অনশন পালন করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যান। জেল থেকে যখন তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় তখন তাঁর সাথে সহযাত্রী হিসেবে মহিউদ্দিন নামের একজন কর্মীকে মুক্তি না দেওয়ার জন্য অত্যন্ত কোমল মনের অধিকারি শেখ মুজিব নিজের মুক্তি নিতে চাইছিলেন না। যদিও মহিউদ্দিন তাঁর বিরোধী মনোভাবের ছিলেন। জীবনে এত বেশি জেল খেটেছেন যে তিনি নিজের সন্তানের কাছেও অপরিচিত ছিলেন। তাঁর ছেলে শেখ কামাল নিজের বাবাকে ‘হাসুর বাবা’ বলেই মনে করতেন। সন্তানের বিচ্ছেদের কষ্ট সইতে সইতে কখন তিনি জাতীয় পিতা হয়ে উঠেছেন বুঝতেই পারেননি। সোনা পোড়ালে যেমন খাঁটি হয় তেমনি পরিবার থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণায় তিনি খাঁটি মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর পূর্ব বাংলার সম্পদ কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি সমৃদ্ধ করা যায় তার চেষ্টা করছিল পশ্চিমা ভূখণ্ডের তথাকথিত কেন্দ্রীয় নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারীবৃন্দ অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে। এ ধরণের অনাচার বা পাচারের হিসাব নিকাশে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ প্রমাণসহ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরলে তারা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীর উপর অত্যাচার ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাড়িয়ে দেয়। শুধু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নয় সেই সাথে তাদের দোসর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে মুসলিমলীগের কর্মীরাও। কারণ, তাদের ধারণা ছিলো আওয়ামীলীগ ইসলামকে ধ্বংস করে দেবে। শুধু তাই নয় পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিকল্পিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে লাগলো। এতে পূর্ব বাংলার কাঁচামালও পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে লাগলো। পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র যত বাড়তে লাগলো ততই আওয়ামী নেতা তপ্ত হতে লাগলেন। তপ্ত আগুন লেলিহান শিখা হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো। বঙ্গবন্ধুর ‘‘জয় বাংলা” শ্লোগানের জন্য ওই সময়ের গোটা ইসলামপন্থী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাঁকে ইসলামের ধ্বংসকারী হিসেবে প্রচার করতো বাঙালি মুসলিমদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য। কিন্তু একজন খাঁটি মুসলিম হিসেবে নিয়ম মত নামায আদায়, কোরআন তেলওয়াতসহ রোযা রাখতেন তিনি। ঈমানদার মুসলিম বলতে যা বুঝায় ।

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমলীগ ও আওয়ামীলীগের মধ্যে পূর্ববাংলার সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হলো। উক্ত নির্বাচনে পূর্ববাংলাবাসী তাদের নেতাকে চিনে নিতে ভুল করলো না। এরপর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নিরস্কুশ জয়লাভের পর তৎকালীন পাক সরকারের বড় বড় সরকারি আমলাদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার হলো। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন বঙ্গনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ জুন ২১ দফা ঘোষণা করা হয় এবং ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের প্রাদেশিক স্বায়ত্ত¦শাসনের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উঠলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিষয়টি আমলে না নেওয়ার কারণে শেখ মুজিব ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্রনেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কতখানি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলে এরকম অগ্রিম পদক্ষেপ গ্রহণ করার চিন্তা করতে পারেন।

এভাবে এক এক করে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে লাগলেন শেখ মুজিব। কিন্তু আবার বিড়ম্বনা সামনে এসে দাঁড়ালো। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে জননিরাপত্তা আইনে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এই বৎসরেই ‘গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে খ্যাত ‘ছয়দফা’ দাবি উত্থাপন করা হয়। অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায় এই ছয় দফা দাবির মধ্যে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। দলের মাথায় স্থান লাভের সাথে সাথে বুঝিয়ে দিলেন মধ্যগগনে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডু পুড়িয়ে মারবে অপশক্তির ধারক ও বাহক পাক শাসনকে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে আমাদের নেতা আবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। পশ্চিমা শাসক যতবারই বঙ্গনেতাকে প্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে জেলে পাঠিয়েছেন ততবারই এক মুজিব থেকে লক্ষ মুজিব রক্তবীজের ন্যায় বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির শক্তিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। বঙ্গনেতার জেলে আটকানো ছিলো বাঙালির স্বাধীকার চেতনায় জাগরণকারী বটিকাস্বরূপ।

১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন একপর্যায় এসে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। গণ-আন্দোলন ভঙ্গ করার জন্য পাক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে কারফিউ এর ঘোষণা দেয়। ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ করলে তাদের উপর পুলিশ, ই.পি.আর.-এর গুলিবর্ষণ হয়। এতে বহু হতাহতের মধ্যদিয়ে এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। যাকে ইতিহাসের পাতায় গণঅভ্যুত্থান বলে। ২৩ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রসমাজের ১১ দফাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেন। ১০ মার্চ রাওয়ালপিণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে দাবি উত্থাপন করেন। “গণ অসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।”

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু আবার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ‘নৌকা’ প্রতীক প্রছন্দ করেন। ভাটি অঞ্চলের মানুষ হিসেবে স্বপ্নদ্রষ্টার ন্যায় ভেসে বেড়ানোর স্বপ্ন থেকেই তিনি নৌকা করে স্বাধীনতার স্বপ্নচারী হয়েছিলেন। সেজন্য তিনি নৌকাকেই নিজের বাহন করলেন। ২৮ অক্টোবর তিনি বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টিভিতে ভাষণ দিয়ে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করতে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নর্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনের ফলাফলেই বোঝা যায় মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর পরিধি কতদূর ব্যাপী হতে পারে। অথচ এই জয়ের পরেও নির্বোধ শাসকগোষ্ঠী আমাদের নেতাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলো না। এতে জ¦লন্ত সূর্য আরোও জ¦লতে লাগলো। তুষের আগুন নাড়া দিলে যা হয় আর কি।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আলোচনা সফল করেননি। ৩ মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিকে বঙ্গবন্ধু ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে তীব্র সমালোচনা করে বলেন যে, ‘ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। কারণ ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ’। কতখানি দৃঢ়চেতা এবং আত্মবিশ^াসী হলে এমন বাণী উচ্চারণ করা যায়। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৭মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রের মঞ্চে তিনি উঠলেন এবং বললেন …“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ‘জয়বাংলা’… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।”

৭ মার্চের ভাষণের এক একটি শব্দ যেন এক একটি স্ফুলিঙ্গ। বঙ্গনেতার মুখ দিয়ে যখন শব্দগুলো বের হচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন এক একটি স্ফুলিঙ্গ ছুটে ছুটে জনগণের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ছে। এরপরই তিনি ঘোষণা দিলেন অসহযোগ আন্দোলনের। ইয়াহিয়া সরকারের সাথে কোনরকম কর্মকাণ্ডে আমরা সহযোগিতা করবো না। অসহযোগ আন্দোলন মোকাবেলার চেষ্টা থেকে ইয়াহিয়া সরকার ‘অপারেশন দ্যা সার্চ লাইট’ নামে একটি ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা করে। যার প্রকাশ ঘটে ২৫ মার্চ রাতে। ২৫ মার্চ রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর কয়েক মিনিট পরই পাক আর্মি কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করানো হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আটক রাখা হয়। তাতে কি হয়েছে। বাঙালি জনতা নিজেরাই এক একজন মুজিবে পরিণত হয়েছে। কারণ ৭ মার্চের ভাষণের প্রত্যেকটা কথা বা উচ্চারিত শব্দ যেন এক একটা বুলেট হয়ে বাঙালির হৃদয়কে বারুদে পরিণত করেছে। যুদ্ধের ময়দানে সশরীরে শেখ মুজিব না থাকলেও ছায়ার মত মুক্তিবাহিনীর চেতনায় মূর্তিমান ছিলেন। যা দিয়ে তিনি আপামর বাঙালিকে রাজপথে নামিয়ে দিলেন।

পিতৃহৃদয় কত বিশাল হতে পারে তা বঙ্গপিতাকে দেখলে বোঝা যায়। তিনি শুধু হাসিনা রেহেনার পিতাই ছিলেন না; তিনি ছিলেন লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গনার পিতা। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যে সমস্ত মহিয়সী নারী তাঁদের মূল্যবান সম্পদ বিসর্জন দিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাঁদেরকে সমাজ সংসার সম্মান বা থাকার জায়গা পর্যন্ত দিচ্ছিল না এমন কি পরিচয় পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছিল না: তখন বঙ্গপিতা দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করলেন, “ শেখ মুজিব ওঁদের পিতা। ওঁরা নিঃস্ব নয় ওঁদের পিতা আছে।” শুধু শুধু তিনি জাতির জনক হননি।

দীর্ঘ নয় মাসব্যাপি যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলো। একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হলো। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা শত্রুর কবল থেকে পূর্ণ মুক্তি পেলাম। কিন্তু আমাদের নেতা তখনো মুক্ত নন। তখনো তিনি বাংলার মাটিতে পা রাখতে পারেন নি। ১৯৭২ এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান এবং ১০ জানুয়ারি তিনি তাঁর মাতৃভূমি বাংলার মাটি ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। ১২ জানুয়ারি তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলার অকৃতজ্ঞ কিছু কুসন্তান যারা মীরজাফরের বংশধর হিসেবে পরিচিত সেই কুলাঙ্গার জানোয়ারেরা বাংলার আকাশের সেই স্বাধীন সূর্যের আলো চোখে ধারণ করতে পারলো না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সেই আলোকে নির্বাপিত করার মানসে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে অতর্কিত হামলায় বঙ্গসূর্যসহ অনেকগুলো নক্ষত্রকে চিরতরে অন্ধকারে নিমজ্জিত করলো। তাতেও পরাশক্তি শান্তির জয় লাভ করতে পারলো না। কারণ সূর্য কখনো চিরতরে মেঘে ঢাকা থাকে না- সাময়িক হয়তো আড়ালে থাকে। বাংলার আকাশেও তাই ঘটলো। অল্পদিনের মধ্যেই বঙ্গতনয়া নতুন আলোর বার্তা নিয়ে পূর্ব আকাশে উদিত হলেন এবং বাংলার আকাশকে নতুন আলোয় আলোকিত করলেন। কায়া বঙ্গবন্ধু না থাকলেও ছায়া বঙ্গবন্ধু তাঁরই আত্মজার মাথার উপরে শক্তি হয়ে জ¦লজ¦ল করছেন। যতদিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি বিশে^র বুকে বেঁচে থাকবে ততদিন বাংলার আকাশে শেখ মুজিব জ¦লবে।

(লেখক ঃ অধ্যক্ষ, পাংশা সরকারি কলেজ, পাংশা, রাজবাড়ী)

Please Share This Post in Your Social Media

One thought on "বঙ্গনেতা"

  1. Md. Anowar Hossain says:

    আলহামদুলিল্লাহ।
    আম্মাজান, আপনার লেখার মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য আজ জানতে পেরেছি। তাই আপনাকে ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com