মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৩ অপরাহ্ন

ভুল সবই ভুল । এড. লিয়াকত আলী বাবু

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩
  • ১০৬ Time View

আসামানী হিসাব আনুযায়ী আদম হাওয়াই নাকি সর্ব প্রথম ভুলের উদ্বোধন করেছিল। সেদিন আদম হাওয়া ভুল না করলে এ পৃথিবী সৃষ্টির হয়তো কোন প্রয়োজনই ছিল না। আদম হাওয়ার গন্ধম খাওয়াই ছিল ভুলের প্রথম সুত্রপাত। অবশ্য আরেকটু পেছনে তাকালে অন্য আরেকটা হিসাবও পাওয়া যায়। সেই হিসাব অনুযায়ী শয়তান কুলের শীর্ষ শিরমনি ব্যাটা খবিসের ছেলে ইবলিস আল্লাহ পাকের হুকুমে আদমকে সেজদা না করাটাই ছিল ভুলের প্রথম হাতে খড়ি। সেই আদি কালে শুরু হওয়া ভুলকে আর কেউই কখনো ভুলে যেতে পারে নাই। তারই ফলশ্রুতিতে মানুষ অনন্তকাল ধরে সেই ভুলের খেসারত দিতে দিতে আজ এই অবস্থায় এসে উপনিত হয়েছে। আর এ কারণেই বাংলার বিদগ্ধ এক গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার “ভুল সবই ভুল, এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা” এইটুকু লিখেই বিখ্যাত হয়ে আছেন। তবে হ্যাঁ ভুলে ভরা এ পৃথিবীতে ভুল হতেই পারে। কারণ, জীবনের পাতায় পাতায় যা যা লেখা হয়েছিল তাতো আর আধুনিক কলকব্জা কিংবা কম্পিউটার দিয়ে লেখা হয় নাই। কিন্তু জেলা সদরের একজন নামকরা ডাক্তার আমাকে কম্পিটারাইজড আধুনিক কলকব্জা ও কম্পিউিটার দিয়ে পরীক্ষা করানোর পর একটা ভুল প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলো। ঐ প্রেসক্রিপশন ভুল হলো কি করে ? জেলার বড় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতে ঔষধ খাওয়ার পর অসুখ সেরে যাওয়াতো দূরের কথা অসুখ আরও ঊর্ধ্বগতিতে দ্বিগুন হারে বেড়ে যেতে লাগলো। তড়িঘরি করে ঢাকার এক নাম করা মহা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরনাপন্ন হলাম। ঢাকার মহা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রায় পাঁচ সাত হাত লম্বা সাইনবোর্ড এবং ‘এ থেকে জেড’ পর্যন্ত ডিগ্রীর বহরতা দেখে মনটাও ভরে গেল। মহা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দেখা পেতে অন্তত পনের দিন আগে নাম লেখাতে হয়। তবে গোপনে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল তলে তলে দেশীয় সিষ্টেমও চালু আছে। হাতে কিছু ধরায়ে দিলে ঐ দিনই লাইনের আগে থাকা যায়। যে যাই বলুক না কেন, আমাদের দেশীয় সিষ্টেমটা কিন্তু একেবারে খারাপ না। তবে এতকিছুর পরও সকাল ৯ টায় লাইন দিয়ে বিকাল ৫টায় মহা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সামনে গিয়ে বসার সুযোগ হলো। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সাহেব প্রথমেই আমাকে তাহার রুমের পাশে থাকা ল্যাবের মধ্যে নিয়ে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতির মধ্যে ঢুকায়ে আদ্যপান্ত পরীক্ষা করে নিয়ে পূর্বের প্রেসক্রিপশন দেখেতে চাইলেন। আমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সামনে জেলা সদরের প্রেসক্রিপশন খানা তুলে ধরতেই তিনি চোখ চরখ গাছে উঠিয়ে নিজের জিহ্বায় শক্ত একটা কামড় দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এর অনেকক্ষন পর চোখ নামিয়ে বললেন- ‘হায় আল্লাহ আপনি এ কি করেছেন? আপনি এতদিন বেঁচে আছেন কি ভাবে ? বিশেষজ্ঞের কথা শুনে আমার কলিজার মধ্যে হঠাৎ একটা চিলিক দিয়ে উঠলো। বলে কি ? কত বড় সর্বনাশা কথা। আমার নাকি এতদিন ভুল ট্রিটমেন্ট চলে আসছিল। রক্ষা এই যে, সৌভাগ্য ক্রমে সময় মত এই মহা বিশেষজ্ঞের কাছে আসতে পেরেছি। আরও কিছুদিন এ ভাবে ট্রিটমেন্ট চলতে থাকলে নাকি সামনের মাসেই আমার চল্লিশার অনুষ্ঠান করতে হতো। কি ভয়ানক অলুক্ষুনে কথা বলেনতো দেখি!! এতো দেখছি সরাসরি জীবন নিয়ে ফাইজলামো করা হয়েছে। আমি করজোড়ে বিশেষজ্ঞের দিকে হাত তুলে জানতে চাইলাম স্যার আমার শেষ রক্ষা হবেতো ? আমার অসম্বাদে বৌ ছেলে মেয়ে একেবারে এতিম হয়ে যাবে স্যার। বিশেষজ্ঞ স্যার একটু মুচকী হেসে চোখের ভারী চশমাটা সামনের টেবিলের উপর রেখে বললেন-এখন নাকি আর আপাতত কোন ভয় নাই। ঠিক সময়ে স্যারের নেক নজরে আসতে পেরেছি এটাই রক্ষা। বিশেষজ্ঞ স্যার আমার মল-মুত্র রক্তের গোত্র সব পরীক্ষা করে প্রায় দেড় হাত লম্বা একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেন। শুরু হলো আমার দ্বিতীয় পর্বের চিকিৎসা। প্রায় দুই মাস পার হয়ে গেল। কিন্তু না তাতেও কোন কাজ হলো না। আমার শরীর শুকায়ে প্রায় হাড়ের সাথে চামড়া ল্যাপ্টায়ে যেতে লাগলো। চোখ ঢুকে গেল গহীন গর্তের মধ্যে। স্বয়ং আজরাইল গায়ে হাত দেয় দেয় ভাব হয়ে গেলো। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সকলেই ভারতে যাওয়ার উপদেশ দিতে লাগলো। আর উপায় নাই। রীতিমত জীবন মরনের সন্ধিক্ষন। অবশেষে একদিন ভাদ্র মাসের ভর দুপুরে ভারতের আলীপুরের এক নামকরা হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানেও লাইনের ব্যাবস্থা। মনে হয় সারা দেশের মানুষই অসুস্থ। অল এক্সপার্ট ডাক্তার বাবুর দেখা পেতে পাঁচ দিন পার হয়ে গেল। তারপর কোন এক সোমবারে সকাল থেকে অপেক্ষায় থাকার পর প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ ডাক্তার বাবুর সামনের চেয়ারে বসার সুযোগ হলো। ডাক্তার বাবু আমার দুই দুইটা প্রসেক্রিপশন সামনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর ডাক্তার বাবু নিজের মাথার চুল নিজে টানতে টানতে বললেন-স্রেফ আজরাইলের ভুলের কারনে আপনি এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। আমার নাকি ভয়ানক ভুল চিকিৎসা হচ্ছিল। কি ভয়ানক কথারে বাবা। আসলেই নাকি তাই। আজরাইলের ভুল না হলে নাকি আমার কিছুতেই বেঁচে থাকার কথা না। আর মাত্র পনের বিশ দিন পরে গেলেই পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই নাকি আমাকে পরপারে পুশব্যাক হতে হতো। ঐ অলুক্ষেনে কথা শুনে কার মন মেজাজ ভালো থাকে বলুন ? ভিতরে ভিতরে আমার জ্বর জ্বর ভাব অনুভব হতে লাগলো। হাত পা’র মধ্যে একটা অবশ অবশ ভাব চলে আসছিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে লাগলো। অল এক্সপার্ট ডাক্তার বাবু ঢাকার মহা বিশেষজ্ঞের প্রেসক্রিপশন উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে দাঁত কিড় মিড় করতে লাগলেন। তারপর বললেন ভুল সবই ভুল প্রেসক্রিপশনের পাতায় যা লেখা’। সৃষ্টিকর্তা বড়ই দয়াময়। সে যাত্রায় ভুল ভ্রান্তির ভেলায় ভেসে ভারতের ভুবনীমোহন ভুল সংশোধনী মেডিক্যাল সেন্টার থেকে নবজীবন লাভ করে বাড়িতে ফিরে আসতে সক্ষম হলাম বটে কিন্তু ভুলের ভোগান্তি কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছিল না। ভুল ভ্রান্তির সূত্র ধরেই বাড়ীতে ফিরে আসার পর জমাজমির জটিলতায় জড়ায়ে হঠাৎ একটা ফৌজদারী মামলার প্যাচে আটকে যেতে হলো। কি আর করা। অবশেষে কাগজপত্রের গাঁট বেঁধে জেলা সদরের একজন নাম করা উকিল সাহেবের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। উকিল সাহেব আমার কাগজ পত্র ঘেঁটে ঘুঁটে হটাৎ দু’চোখ উঁচু করে হাতে তালি মেরে বলে উঠলেন ‘কুছ পরোয়া নেই । সব একেবারে পনির মত পাতলা করে বাদীর মামলার বারোটা বাজায়ে দেব। উকিল সাহেবের গরম কথায় মাতোয়ারা হয়ে মালকোঁচা মেরে মামলায় কুপ্তি লড়া শুরু করে দিলাম। ঐযে ভুলের ভোগান্তি আমার পিছু লেগে আছে। সেই ভুলের জের ধরে পাঁচ বছরের জেল দন্ড নিয়ে আমাকে চৌদ্দ শিকের মধ্যে ঢুকে যেতে হলো। আবশেষে আপিলের আবেদনে জামিনে বাহির হয়ে এসে কাগজপত্র নিয়ে এক অল এক্সপার্ট উকিল সাহেবের সেরেস্তায় গিয়ে হাজির হলাম। প্রায় হাফ সেঞ্চুরী করা উকিল সাহেব পাঁচশত পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে আমার মামলার কাগজপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পর্যালোচনা করে কিছুক্ষন চোঁখ বুজে ঝিম ধরে বসে থাকলেন। তারপর মাথা উঁচু করে বললেন “আরে মিয়া আপনি দেখছি ছাগল দিয়ে মলন মলিয়েছেন “কোন উকিল সাহেবেরতো এত বড় ভুল করার কথা না। ভুল সবই ভুল। একেবারে গোরায় গলদ করে ফেলেছে। এরপর উকিল সাহেব চোখের থেকে ভারী চশমাটা নামিয়ে নিয়ে চশমার কাঁছ মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন- জেলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া নাকি খুবই দূরহ ব্যাপার। জুনিয়র উকিল সাহেব নাকি ভুলে ভুলে কেসটা’কে একেবারে ভন্ডুল করে রেখেছে। সিনিয়র উকিল সাহেবের চশমার কাঁচ মোছা শেষ হলেও তখনও আমার চোখের পানি মোছা শেষ হয় নাই। সিনিয়র উকিল সাহেব আমার চোখে পানি দেখে চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পিঠের উপর একটা থাপ্পর দিয়ে বললেন আরে ব্যাটা শুনিশ নাই আমার নাম ডাক ? আইনের আছে হাজার হাজার ফাঁক। যে পথ দিয়ে সুই চলে না সেই পথে আমি কুড়াল চালিয়ে দেই। আর তোর কেসটা তো আমার কাছে নস্যির মত। নাকের কাছে নিয়ে একটান দিলেই নস্যির মতই কেস শেষ। জাঁদরেল সিনিয়র উকিল সাহেবের জোড়ালো কথায় আমার মরুভুমির মত শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়টা কিছুটা হলেও ভিজে উঠলো। উকিল সাহেব তখনই আলমারী হইতে বেকায়দা সাইজের কয়েকখানা আইনের বই বের করে পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলেন ইউরেকা ইউরেকা পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি আসল আইন। ইউ হ্যাভ এ গুড লাক-আইনের পেয়েছি বিশাল ফাঁক। উকিল সাহেব এমন ভাব করতে লাগলেন যে পারেতো তখনই আইনের ফাঁক দিয়ে আমাকে বের করে নিয়ে আসেন। কিন্তু বিধি যদি হয় বাম তাহলে কপালে তখন আর হয় না কোন কাম। অবশেষে আইনের আলওয়ালা আংটায় আমাকে আটকেই যেতে হলো। আপিলে জেল বহাল হয়ে গেল। সিনিয়র আইনজীবী বললেন সবই ভুল। আদালতও কিনা সর্বশেষ ভুল করে বসলো ? অবশেষে হ্যাঁতা খ্যাঁতা বেচে দিয়ে পকেট ভরা টাকা নিয়ে ভুলের খেশারত মেটাতে হাইকোর্টে গিয়ে হাজির হলাম। দুই দিন ধরে লাইন দিয়ে হাইকোর্টের একজন নামকরা ব্যারিষ্টার সাহেবের কাছে আমার জেল বহাল থাকার নথি খানা পেশ করা হলো। ব্যারিষ্টার সাহেব আমার মামলার নথি খানা বেশ মনোযোগ সহকারে দেখে কিছুটা চমকে উঠলেন। মামলার নাকি নাই কোন কুল-আপীলেও ধরা পরেছে হাজার হাজার ভুল। যেখান দিয়ে সূই চলে না সেখান দিয়ে কুড়াল চালালে যা যা হয় তাই তাই নাকি হয়ে গেছে। সব শেষে ভাগ্য কিছুটা সুপ্রসন্ন হলো। অবশেষে ভুল ভোগান্তির আপাতঃত অবসানও হলো। হাইকোর্ট থেকে খালাস হয়ে হাফ ছেড়ে গঙ্গাস্নান দিয়ে বাড়ীতে চলে এলাম। ওমা বাড়ীতে এসে একি শুনলাম ? আমি একি শুনলাম গো ? এসএসসি গ্রেডিং পদ্ধতিতে আমার ছেলের গলা আটকায়ে নাকি মরার মত অবস্থা হয়ে গেছে। গৃহ শিক্ষক বললেন এবার নাকি প্রশ্ন পত্রে ছিল শুধু ভুল আর ভুল। তারপর কম্পিউটারের ভুলে নাকি আমার ছেলে ধরা খেয়েছে। ভুল কিন্তু সর্বশেষ আমার পিছু ছাড়লোই না। ভুলের ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমার চাকুরী জীবনের অবসান হযয়ে গেল। এর পর শুরু হলো আমার পেনশনের টেনশন। অবসর ভাতা পাওয়ার ভোগান্তি শুরু হয়ে গেল। চাকুরীর ফাইল বোগল দাবা করে এ অফিস থেকে ও অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করে দিলাম। এরপর অবাক হলাম সেদিন যে দিন শুনলাম যে আমার সার্ভিস বুক নাকি ভুলে ভুলে ভরা। অথচ বিগত সাইত্রিশটি বছর ধরে চাকুরী করে আসছি কোন দিনও আমার সার্ভিস বুকের ভুল ধরা পরলো না। তবে আমার আসল ভুল ভাঙ্গিয়ে দিল এজি অফিসের একজন পিয়ন। সে একটু মুচকি হেসে বৃদ্ধাঙ্গুলের সাথে শাহাদৎ আঙ্গুলের মাথা ঘষতে ঘষতে অর্থের ইঙ্গিত দিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিশ ফিশ করে বললেন “স্যার ভুল পথে ঘুরা ঘুরি করছেন”। জীবনের শেষ দ্বার প্রান্তে এসেও ভুল পথে ঘুরা ঘুরি করছি ? তাহলে কি সর্বশেষ এ কথাই ঠিক যে ভুল সবই ভুল এ জীবনের পাতায় যা লেখা। তার পরেও আরও একটু বাড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করে “ভুল করিতে ভুল করেছেন সৃষ্টি বিধাতায়, না হলে কি মানব জীবন ভুলে ভরে যায়” ?
লেখক: আইনজীবী

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com