বঙ্গবন্ধুর “জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর জাতির জনকের বিশ্ববন্ধু স্বীকৃতি ও বাংলাদেশের অনন্য আন্তর্জাতিক সম্মাননা।
শাহ মুজতবা রশীদ আল কামাল
১০ই অক্টোবর ১৯৭২ চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে “জুলিও কুরি শান্তি পদক” প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্বের ১৪০ টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে” জুলিও কুরি শান্তি পদক” প্রদানের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দু’দিনব্যাপী “ASION PEACE AND SECURITY CONFERENCE ” এক আড়ম্বরপূর্ণ সেই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক পরিয়ে দেন পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র।
সেই অনুষ্ঠানে রমেশচন্দ্র বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন,তিনি সারা বিশ্বের, “বিশ্ববন্ধু “। স্বাধীন বাংলাদেশ কোন রাষ্ট্রনেতার সেটিই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক পদক লাভ। বাংলায় এই পদকের নাম জুলিও কুরি বলা হলেও এর ফরাসি উচ্চারণ “জ্যোলিও কুুরি”। ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জ্যোলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বশান্তি পরিষদ তাদের নামে শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে রাখে “জ্যোলিও কুরি”। ফ্রেডারিকের মূল নাম ছিল জঁ ফ্রেডারিক জোলিও। ফ্রেডারিকের স্ত্রী ইরেন কুরি। তিনিও বিজ্ঞানী। বিয়ের পর ফ্রেডারিক ও ইরেন উভয়ে উভয়ের পদবী গ্রহণ করেন। তাঁরা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রেডারিক জ্যোলিও কুরি শুধু বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেননি,তিনি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে এবং নিজেদের জন্য হাতিয়ার তৈরি করতেও অবদান রাখেন। তাদের অবদানের জন্য বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্তি সহজতর হয়। তিনি নিজে বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতিও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক প্রাপ্তির আগে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের সংগ্রামী নেতা হো চে মিন চিলির গণআন্দোলন নেতা সালভাদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের জনদরদী নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রমূখ এই পদকপ্রাপ্ত হয়েছেন। মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ বিরোধী এবং মানবতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন তাঁরা এই পদকে ভূষিত হয়ে আসছিলেন ১৯৫০ সাল থেকে। মানবদরদী বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অদম্য বাসনা তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত হয়েছিল ছেলেবেলা থেকেই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগের পর তিনি মুক্তিপান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। আর সে বছরই অক্টোবর মাসে চীনে অনুষ্ঠিত হয় “PEACE CONFERENCE OF THE ASIAN AND PASAFIC REGION”এই সম্মেলনে ব্ঙ্গবন্ধু যোগ দিয়ে তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে অন্য ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তি কামী নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছিলেন।”আমার দেখা নয়াচীন “গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু অংশ নেন। শান্তি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, শোষিত ও শান্তিকামী সংগ্রামী মানুষ যেকোনো স্থানেই হোকনা কেন তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি।আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাঁকে সুসংহত করা হোক ” বঙ্গবন্ধু যে পররাষ্ট্রনীতি প্রনয়ণ করেছিলেন তার মূল কথা ছিল “সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব,কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।
বায়ান্নর ২১ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য বাঙালিদের যে রক্তদান শুরু হয়েছিল এই ধারা অব্যাহত ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। পাকিস্তানীরা শুধু বাঙালিদের অত্যাচার নির্যাতনই করেনি তারা গণহত্যা করেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। পাশাপাশি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উত্থান আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র সেটিও ছিল খুবই অমানবিক। বঙ্গবন্ধু এই দু’টোর বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সাহসী উচ্চারণ “পৃথিবীতে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে, মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা খর্ব করা হবে, যখন শোষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হবে শোষকের স্বার্থের ইমারত তখনো কি নিরপেক্ষতার নামে নির্লিপ্ত থাকবে বাংলাদেশ? না।” বঙ্গবন্ধু সেই নেতা ছিলেন না তিনি স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন “পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে ” বঙ্গবন্ধু দেশ বা বিদেশ যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখেন, মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সংবাদ পান, সেখানেই প্রতিবাদের ঝড় তোলেন৷ এই প্রতিবাদ জাতীয় স্তর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও৷ দেশি বিদেশি শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে তাঁর নেতৃত্বে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷ স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে জোড় দিয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ওপর৷ বিশ্ব রাজনীতিতে তখন প্রত্যফ দুটো ব্লক ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ তাছাড়া ছিলো সামরিক জোটও৷ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কোন সামরিক জোটে যোগ দেয়নি৷ তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন “আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিজোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি৷ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়৷ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল৷ তাই সামরিক জোট গুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি৷
বঙ্গবন্ধু আরও বলেছেন, “মুক্তিকামী মানুষের ন্যয়সংগত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না, সেজন্য ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি, বিসাও সহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুন্ঠ সমর্থন৷ আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি আরব এলাকা ইসরায়েল দেশ জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে আমরা দিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিন আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির৷ আমরা সমর্থন জানাই বিশ্ব শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানব কল্যাণের যেকোনো মহৎ প্রচেষ্টাকে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের এই ঊচ্চারণ আজও সমান ভাবে প্রাসাঙ্গি, কেনোনা ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র এর আঘাতে এখনো হতাহত হচ্ছে ফিলিস্তিনের নিস্পাপ মানুষ৷ ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঐতিহাসিক ভাষনে তিনি বলেন, আমাদের একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব হল বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যাতে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মর্যাদার উপযোগী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। বঙ্গবন্ধুকে জুলিওকুরি শান্তি পদক প্রদান আন্তর্জাতিক সম্মান ও স্বীকৃতির মাইলফলক৷ এই সম্মান আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে শান্তির অগ্রদূত হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে৷ বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহবান বাস্তবায়নের মধ্যেই তো রয়েছে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর জুলিওকুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তিতে আজও মহান নেতাকে খুঁজে পাই আমাদের চেতনার মাঝে বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে।
শিল্পীর গানের মর্মস্পর্শী সুর আজ ভেসে আসছে,
“যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই…
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা…
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা”
আজি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতাকে
জয় বাংলা,
জয় বঙ্গবন্ধু।