১৯৮৮ সালের শেষের দিকে ‘বিনা বেতনের চাকরি’ সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সাথে বয়সের ভারে অন্য কোন কাজও করতে পারেন না। সন্তানদের আয়ের উপর নির্ভরশীল। শরীর এই ভাল, এই মন্দ। ঔষুধের উপর নির্ভর করেন। অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা করাতে পারেন না। একা একা চলাচল করতে পারলেও অনেক কিছু ভুলে যায়। দিন কাটে বাজার-ঘাটে ঘুরে ঘুরে। সন্ধ্যার পূর্বে বাড়ী ফিরে যায়। অসুস্থ্য হয়ে পরলে বিছানায়। কথাগুলো বলছি অবসর প্রাপ্ত মফস্ফল সাংবাদিক শামসু রিপোর্টারের কথা। পুরো নাম শামসুল হক। তৎকালীন ষাট/সত্তর দশকের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় শামসু রিপোর্টার হিসেবে পরিচিত তিনি। বয়স ৯০ ছুঁয়েছে। বয়সের ভারে সাংবাদিকতা ছেড়েছে ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে। তবে দৈনিক পত্রিকা পড়ার নেশা রয়েছে। এখনও ছুটে যায়, ছুঁটে চলে বাজার-ঘাটে। বিকেল হলে ছুটে আসে “গোয়ালন্দ প্রেসক্লাব” অঙ্গঁনে। গোয়ালন্দ প্রেসক্লাব ১৯৭২ সাথে মাত্র ৭জন সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে অবসর কালীন পর্যন্ত গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন সুনামের সাথে। শুধু আড্ডা আর দৈনিক পত্রিকা পড়ার নেশায় প্রেসক্লাবে এসে পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়েন। বয়সের ভারে নতুন-পুরাতন পত্রিকা বুঝতে পারেন না। হাতের কাছে যে পত্রিকা পাচ্ছেন মনোযোগ সহকারে পড়তে শুরু করেন। মাঝে মধ্যে চলে চা চক্র। কখনও কখনও চলে স্মৃতি চারন। তার হাতের লেখায় তুলনা নেই। টাইপ করার মত হাতের লেখা এখনও। প্রতিটি শব্দ নির্ভুল বানান। বেশি চাহিদা নেই। একটি লাল চা। স্মৃতিচারণ এবং চা চক্রের শেষে ১০/২০টি টাকা দিলে খুশি। চা খেয়ে রিক্সা ভাড়া দিয়ে সোজা বাড়ী।
ষাটের দশকে দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কাজ করেছেন দৈনিক আজাদী, দৈনিক ইত্তেফাক সহ বিভিন্ন জাতীয় সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকায়। না, টাকার পিছনে কখনও ছোটেননি। সাংবাদিকতা করে টাকা রোজগার করা যায় সেটাও বুঝতে পারেনি। সার্বক্ষনিক ভেবেছেন সাংবাদিকতা সেবামূলক কর্ম। মহান এই পেশায় টাকা দিয়ে মূল্যায়ন হয় না। তাই বিনা বেতনে কর্মজীবন শুরু করে ছিলেন। কর্মজীবন শেষ করেছেন বিনা বেতনে। না, এখন কোন আয়-রোজগার করতে পারেন না। সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছেন। একাধিকবার সরকারি চাকরীর সুযোগ পাওয়ার পরও সাংবাদিকতা ছাড়েনি। ভাল বাসার টানে সাংবাদিকতা ছেড়ে যাওয়া হয়নি। তাই বিনা বেতনে চাকরী করেও আনন্দ উপভোগ করেছেন।
কর্মজীবনে শহিদুল ইসলাম জনি ও অহিদুল ইসলাম রাজু নামের দুইজন ছেলে এবং রেশমা নামের একটি মেয়ে রয়েছে। দুই ছেলে কারেন্ট এর মিস্ত্রি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়ে এখন সংসারী।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শামসু রিপোর্টার বলেন, বঙ্গবন্ধু অনেকবার গোয়ালন্দ এসেছেন। গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ষ্টিমারে নারায়নগঞ্জ-ঢাকা আসা-যাওয়া করতেন। অনেকবার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছি। তৎকালীন গোয়ালন্দ মহাকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডাক্তার জয়নাল, লতিফ হাজী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বার, নিতাই রাহা, নাজিরুল ইসলাম দুদু, জলিল চেয়ারম্যান, মজিদ মেম্বার, নিকবার আলী মোল্লা ও শেখ মো. ছবেদ আলী সহ অনেকে ছুঁটে আসতেন। সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য আমিও ছুঁটে চলেছি তাদের সাথে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক রিপোর্ট করার সুভাগ্য হয়েছে। কিন্ত দারিদ্রতার কোষাক্ষাতে সন্তানদেরও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। সাংবাদিকতার নেশায় নিয়মিত কাজ কর্ম করতে পারিনি। বিনা বেতনের সাংবাদিকতার নেশায়, ভাল সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও করিনি। বিনা বেতনে সাংবাদিকতা করলেও “পত্রিকার পাতায় যখন নিজের লেখা সংবাদ দেখতাম। তখন সব যন্ত্রনা ভুলে যেতাম। এটাই হচ্ছে মফস্ফল সাংবাদিকতার বাস্তব চিত্র।
স্মৃতি চারন করতে গিয়ে শামসু রিপোর্টার আরো বলেন, এখন মাঝে মধ্যে শুনি বা দেখি হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতা বুঝি না। তবে বর্তমান মফস্ফল সাংবাদিকরা দল ধরে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভয়ভীতি দেখিয়ে থাকেন। নীতিমালার কোন তোয়াক্কা করেন না। সাংবাদিকতার দাপটে জায়গা জমি দখল করেন। সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করে কন্টাকে সংবাদ প্রকাশ করেন। একটি ছবি তুলে টাকার জন্য পিছনে পিছনে ঘুরেন। আত্ম-সম্মান বিসর্জন দিয়ে মিলাদে গিয়ে টাকা চেয়ে বসেন।
বয়স্ক এই শামসু রিপোর্টার (সাংবাদিক) দুঃখ করে বলেন, মফস্ফলের অনেক সাংবাদিক ইংরেজি দুরের থাক বাংলায় শুদ্ধ ভাবে লেখতে বা বলতে পারেন না। তবে, গলায় কার্ড ঝুঁলিয়ে চাঁদাবাজি করেন শুদ্ধ ভাবে। তিনি বলেন, তৎকালীন আমরা বিনা বেতনে সাংবাদিকতা করেছি। সুতরাং বাধ্য হয়ে এই নেশাযুক্ত পেশার পাশাপাশি অন্য কিছু করেছি। বর্তমান মফস্ফল সাংবাদিকদের কেমন বেতন দেয় আমার জানা নেই। তবে মফস্ফল সাংবাদিকদের লাইফ ষ্টাইল দেখলে মনে হয় উচ্চ বিতনে চাকরী করেন।
সাংবাদিকতা করে কিছু করতে না পারার জন্য দুঃখ নেই তার। তবে শেষ বয়সে সরকারের কাছে একটি দাবি করে তিনি বলেন, মফস্ফল সাংিবাদিকদের জন্য কিছু করার প্রয়োজন। কারণ মফস্ফলের সাংবাদিকগন অনেক কষ্ট করে রিপোর্ট তৈরি করেন। সুতরাং তাদের সেই মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যেন সন্তানদের নিয়ে শেষ বয়সে কষ্ট করতে না হয়। অভাবের কারণে যেন হলুদ সাংবাদিকতা করতে না হয়। মফস্ফল সাংবাদিকগন যেন সমাজের দর্পন হয়ে কাজ করতে পারেন।