মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৮ অপরাহ্ন

রাজবাড়ীর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বাকাউল আবুল হাসেম (যুদ্ধকালীন কমান্ডার) রাজবাড়ী।

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২
  • ৪১৩ Time View

গোয়ালন্দ মহকুমা গোয়ালন্দ থানা নামে ১৮৮৮ সালে গঠিত হয়। তখন এটি ছিল গোয়ালন্দ মহকুমার অন্তর্গত সদর থানা। পরে গোয়ালন্দমহকুমার নতুন নাম রাজবাড়ী হলে এ থানার নাম হয়রাজবাড়ী সদর থানা এবং গোয়ালন্দ নামে আরেকটি থানা হয়। ১৯৮৪ সালে রাজবাড়ী জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে রাজবাড়ী সদর থানা উপজেলায় উন্নীত হয়। ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে হলো রাজবাড়ী সদর থানা যথাক্রমেঃ- পাঁচুরিয়া,বরাট,দাদসি খানখানাপুর, আলিপুর, শহিদওহাবপুর, বসন্তপুর,সুলতানপুর, মূলঘর,মিজানপুর, খানগঞ্জ, চন্দনী, বানীবহ ও রামকান্তপুর।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠে আসেন এবং বিশাল জনসভায় আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন। সেইদিন তার দেয়া ভাষণ শুনে এলাকার মানুষ ভীষণভাবে উজ্জীবিত হয় এবং আওয়ামীলীগের প্রতি তাদের আস্থা আরো বেড়ে যায়। এর ফলে রাজবাড়ী এলাকার এবিএম নুরুল ইসলাম এবং কাজী হেদায়েত হোসেন বিপুল ভোটে যথাক্রমে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠনের অধিকার পায়। কোন দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি কোন আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে থাকে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একটা দীর্ঘ ও সংগ্রামী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। আমাদের স্বাধীনতা বহু ঘটনার সমাবেশ এর পিছনে আছে অসংখ্য আত্মত্যাগ আর সংগ্রামী নেতৃত্ব। প্রথমেই বাঙালি জাতীয় চেতনা এবং সাহসিকতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, বঙ্গবন্ধুর সহযোগী ০৪ জাতীয় নেতা যারা কিনা বঙ্গবন্ধুর কারাগারে অন্তরীণ থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র। এছাড়া নানা সময়ে নানা ধরনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা আমাদের জাতীয় চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। অনেকে আবার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের অবদানও অনস্বীকার্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবিনাশী শ্লোগান ছিলো জয়বাংলা, এই ছোট্ট শব্দটা ছিলো বুলেটের মত শক্তিশালী। এই স্লোগান জাতীয় চেতনাকেই সমৃদ্ধ করেনা, এই শব্দটি ছিলো পশ্চিমাদের গাত্রদাহের অন্যতম কারণ। এদেশের ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতহানী পশ্চিমাদের পরাজয় তরান্বিত করেছিলো। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেকেই বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পীদের বাংলা গান ছিলো কামানের ধ্বনির মতই শক্তিশালী, স্বাধীনতা বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের খবর পড়া হতো। স্বাধীনতা অর্জনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যারা বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখে আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে করে তুলেছিলেন সহজতর তাদের মধ্যে গ্রাম বাংলার ছাত্র-কৃষক-জনতাসহ যৌথ ও মিত্র বাহিনী আমাদের প্রধান সেনাপতি মোঃ আতাউল গনি ওসমানি, ৭জন বীর শ্রেষ্ঠ, এছাড়াও অজ¯্র বাংলার সাহসী সন্তান জাতীয় চেতনাধারী জনসাধারণ এবং দেশী বিদেশি সাংবাদিক বন্ধুগণও ছিলো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সশস্ত্র নায়ক। বাঙালি জাতীয় জীবনের স্বার্থের প্রশ্ন এসেছে, সেইখানেই গর্জে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির জাতীয় স্বার্থে বার বার বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছেন পশ্চিমাদের হাতে, ৭০ এর নির্বাচনে আর ৭ই মার্চের কালজয়ী ভাষণের কথা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার অবদান নিয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।

কিন্তু এই বিপুল বিজয় সত্বেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা না দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা নানারকম চক্রান্ত শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৩ই মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে ও হঠাৎ তা স্থগিত ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে বাঙ্গালিরা ফুঁসে ওঠে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান আমলের সেই উজ্জ্বল রাজবাড়ী শহর বিদ্রোহী জনতার বিক্ষুব্ধ নগরীতে পরিণত হয়। বিজয় আমাদের রক্তে তথ্য চিত্র প্রদর্শনী ইতিহাসের পাতায় অগনিত মানুষের আত্বদান মা বোনের সম্ভ্রমহানী এবং আপাময় বাঙালি জনতার শৌর্য্য-বির্যের ফসল আমাদের বাংলাদেশ। জাতির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জাতীয় ইতিহাসের সর্বোতকৃষ্ট অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার সামগ্রিক সংগ্রামের ফলশ্রুতি এই বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মতো অবিরাম প্রতিবাদ মিছিল ধর্মঘট বিক্ষোভ হরতাল ও অনশন আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন স্থানীয় ছাত্র-যুবক ও আওয়ামী লীগের নেতারা।

৭ই মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সারাদেশের মুক্তিপাগল মানুষের মতো রাজবাড়ীর আপামর জনসাধারণ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। রাজবাড়ীতে অফিস-আদালত হতে পাকিস্তানীদের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। তারপর থেকে অফিস-আদালত হাট-বাজার সব বন্ধ হয়ে যায়। রাজবাড়ী শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুজিব বিল্ডিংয়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মজিবর প্রামানিকের বিল্ডিং এর ছাদে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ আওয়ামীলীগ ওই অফিসে মিটিং করেন। স্থানীয় যুবক ও ছাত্রদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। কাজী হেদায়েত হোসেন (এমপিএ), তার সাথে অমল চক্রবর্তী, ডাঃ আব্দুল জলিল, ডাঃ ইয়াহিয়া খান, এ্যড. ওয়াজেদ চৌধুরী ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ এবং পুলিশ সিভিল প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আওয়ামীলীগের অ্যাডভোকেট আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী, ডাঃ এসএ মালেক, ডাঃ আব্দুল জলিল এবং আরো অনেকে সাংগঠনিক প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ছাত্র নেতাদের মধ্যে মকসুদ আহমেদ রাজা, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, আমজাদ হোসেন, পাঁচুরিয়ার আনোয়ার হোসেন প্রমুখ নেতাগণেরা প্রশিক্ষণ শিবিরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠ ও গোয়ালন্দ হাই স্কুল মাঠ ছিল প্রশিক্ষণের স্থান। ইপিআর থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সেনা সদস্যরা প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।

মহকুমা প্রশাসক শাহ মোঃ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ সি.এস.পি অফিসার এবং পুলিশের কর্মকর্তা এস.ডি.পি.ও কাছ থেকে ডামি রাইফেল নিয়ে রাজবাড়ী শহরের কয়েকটি স্থানে শুরু হয় গেরিলা প্রশিক্ষণ। রাজবাড়ী সদর উপজেলায়(বর্তমান) মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন (এমপিএ)। সাথে ছিলেন ডাঃ আব্দুল জলিল ও ডাঃ ইয়াহিয়া ও এ্যড. ওয়াজেদ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ী সদর থানায় যারা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তাদের প্রত্যেকের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন মুক্তিবাহিনী দল ছিল যেমন, বাকাউল আবুল হাশেমের (এফ.এফ) প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জনের গ্রুপ ছিল। আলম ও আব্দুল জলিলের (এফ.এফ) প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের গ্রুপ ছিল। মোঃ সিরাজ আহমেদের (বি.এল.এফ) প্রায় ১০ থেকে ১২ জনের গ্রুপ ছিল। মোঃ ইসলাম (এফ.এফ)(পাঁচুরিয়া) প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ জনের গ্রুপ ছিল ও কামরুল হাসানের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জনের গ্রুপ ছিল, কামরুল হাসান লালী (এফ.এফ)।

এসব বাহিনী নিজ নিজ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এবং অনেক সময় যৌথ বাহিনী করে রাজবাড়ী গোয়ালন্দ থানা,পাচুরিয়া, গোয়ালন্দ মোড় সহ পাকবাহিনী রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও অবাঙালি বিহারিদের যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের উপর সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা হয়। ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজবাড়ীতে যুদ্ধ করে শত্রু মুক্ত করা হয়।

পাকবাহিনী ঢাকা দখলে নেওয়ার পর তারা ৬ই এপ্রিল একটি বিরাট কনভয় নিয়ে পদ্মাপারে মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটে অবস্থান নেয়। নদী পার হয়ে বিপরীত পারে গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করে।

এদিকে রাজবাড়ীর মুক্তিকামী জনতা, ছাত্র, কৃষক, যুবক যোদ্ধারা কুষ্টিয়া যুদ্ধে জয়লাভের পর দ্বিগুণ উৎসাহে গোয়ালন্দ ঘাটে ব্যাপক প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। হাজার হাজার ছাত্র, কৃষক, জনতা আনছার সদস্য এবং ঢাকা-রাজবাড়ী রাজার বাগ পুলিশ লাইন হইতে ও পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সৈনিক সদস্যরাও গোয়ালন্দ ঘাট প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়।ঐ সময়টা প্রাকৃতিক অবস্থা খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। ঝড়বৃষ্টি ছিল তখন প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। ৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ থানা সদরে বিমান হামলা চালিয়ে ফিরে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। এতে গোয়ালন্দ ঘাটে ঘোষপট্টি নামক স্থানে ৭ থেকে ৮ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ২১শে এপ্রিল ভোর রাতে পাকহানাদার বাহিনী আকাশ, নৌ ও স্থলপথে একযোগে গোয়ালন্দ ঘাট প্রতিরোধ কারীদের উপর আক্রমণ চালায়। এসময় পাক বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকা- ঘটায়। বাহাদুরপুর, মমিনখার হাট পর্যন্ত ইপিআর আনছার ও মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব বাঙ্কার তৈরি করেছিলেন সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় আনসার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন ও তোফাজ্জেল হোসেন সহ শতাধিক মানুষ নিহত হয়। এভাবে পাকহানাদার বাহিনী গোয়ালন্দ ঘাট সংলগ্ন এলাকা ও আশপাশের ঘরবাড়ি ও সাধারণ লোকজনের উপর সরাসরি গুলিবর্ষণ করতে থাকে।

পাক হানাদার বাহিনী ট্যাংক বহর নিয়ে গোয়ালন্দ মোড় হয়ে একটি গ্রুপ ফরিদপুর ও অন্য একটি গ্রুপ রাজবাড়ী সদরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পাক হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দ মোড়ে আসার পর তারা তাদের ম্যাপ দেখেন। ওই সময় একটি হেলিকপ্টার এসে তাদের সকালের খাবার দিয়ে যায় উপর থেকে তারা তা সংগ্রহ করে। নাস্তা করার পর তারা তাদের অপারেশনের উদ্দেশ্যে সকালে ১০:০০ টা হতে ১১:০০ টার মধ্যেই রাজবাড়ী শহরে পৌঁছে যায়। প্রথমে হানাদার বাহিনী কাজী হেদায়েত হোসেনের বাড়িতে আগুন দেয় তারপর বাজারে প্রবেশ করে ব্যবসায়ী বড় বড় দোকানপাটে আগুন দেয়। ইতিমধ্যে রাজবাড়ী বসবাসরত অবাঙালি বিহারিরা স্ব-দলবলে মিছিল সহকারে সৈয়দ আব্দুর রব মাস্টার ও আজাহার, আলাউদ্দিন বিহারীদেরনেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর মেজরের সঙ্গে দেখা করেন।

হানাদার বাহিনীর কর্মকর্তাগণ বিহারিদের সঙ্গে খুবই জরুরি মিটিং-এ বসে। ১-২ঘণ্টার মধ্যে বিহারিদের হাতে অস্ত্র ও গুলি তুলে দেওয়া হয়। চিত্রা হলের পাশে দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল। হানাদার বাহিনী উক্ত স্থানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরে অবশ্য পাকহানাদার বাহিনী রাজবাড়ী শহরের আশপাশে ও অন্য স্থানেও আস্তানা গড়ে তোলেন।

রাজবাড়ী সদর উপজেলার কনভেনশন মুসলিম লীগ কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগের সবুর খান, জামায়াতে ইসলামী এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। পিডিপি নেতা ইউসুফ হোসেন চৌধুরী,মোঃমোহন মিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী রাজবাড়ীর সর্বত্র শান্তি কমিটি রাজাকার আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এনএসএ ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা এবং অবাঙ্গালি বিহারী রিফিউজি কলোনির লোকজন এনএসএফ নেতা জাহাঙ্গীর ভাজন চালার অ্যাডভোকেট রহমত আলী ভাইপো আরো অনেকে। বাঙালি রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে সাধারন হিন্দু মুসলমান নর-নারী হত্যাকা- চালায়।বরাটে ইসলামী ছাত্র সংঘের ফরিদপুর জেলা শাখার একজন নেতা ছিলেন। রাজবাড়ী সদর শান্তি কমিটি রাজাকার ও অন্যান্য জল্লাদ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হলো রাজবাড়ীর অনেক মুসলিম লীগের রাজাকাররা।

২১শে এপ্রিল হানাদারবাহিনী একটি গ্রুপ গোয়ালন্দ ঘাট থেকে বসন্তপুর পর্যন্ত অগ্নিসংযোগ গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাজবাড়ী সদর উপজেলা ও ফরিদপুর এলাকায় প্রবেশ করে। সাজোয়া বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গিয়ে প্রসিদ্ধ পাট ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র খানখানাপুর প্রবেশ করে। খানখানাপুের তারা আব্দুল গনি ডাঃ ও পরেশ সহ খলিফার বাড়ি সহ ০৪টি বাড়ি ঐতিহ্যবাহী সুরাজ মোহিনী ইনস্টিটিউশন সহ শিক্ষক তারাপদ কু-ুর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। খানখানাপুর বাজারে প্রায় ১৫০ থেকে ১৬০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট করে ওপরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়। আসার পথে সিএনবি সড়কের দু’পাশে সদর উপজেলার কল্যাণপুর, বারবাকপুর, আলিপুর, আহলাদিপুর কোমড়পুর,দর্পনারায়নপুর ও শ্রীপুরে রাস্তার পাশে বাড়িঘর পুড়িয়ে হানাদার বাহিনী রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করে। শহরে প্রবেশ করার সময় যে হত্যাকা- করে তার কোনো হিসাব ছিল না। অনাগত হিন্দু মুসলিম নারী পুরুষ ও শিশুসহ অনেক গৃহপালিত পশু ও মারা যায়।

শান্তিবাহিনীর কমিটির লোকজন রাজবাড়ী শহরের রেল স্টেশন এর পাশে বিহারী নেতা আকুয়া বিহারী দোতলা ভবনে রাজাকারদের অফিস স্থাপন করে। সেখানে ছিল একটি টর্চার সেল। শান্তি কমিটি এখানে বসে মুক্তিবাহিনী বিরোধী তৎপরতা চালাতে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করতো। গুলি করে হত্যা করার আদেশ দিতেন সৈয়দ খামার (মাষ্টার মাইন্ড)।

লোকসেড বধ্যভূমি, নিউ কলোনী বদ্ধভূমি,ভাজনচালা, দাসবাড়ী বধ্যভূমী, স্টেশন কলোনি বধ্যভূমি, আলাদিপুর হাই স্কুল বধ্যভূমি পাক বাহিনী রাজবাড়ী সদর উপজেলায় প্রবেশের পর থেকে উপজেলা মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীর রাজাকার’ বিহারী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে’ অত্র এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধা পাংশা থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাগণ সহ বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন।

৩০শে এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী লক্ষীকোল রাজারবাড়ি আক্রমন করে রাজারপুত্র (পাগল) হারুন সহ স্থানীয় কয়েকজন হিন্দুদের কে হত্যা করে এবং বাড়িঘর লুটপাট করে।

পরে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। পরেরদিন ১লা মে পাক হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় বিহারী রাজাকার একটি জিপে করে লোকোশেড ব্রিজ নুরপুরের রাস্তার মুখে পুকুরপাড়ে রাজবাড়ী কলেজের পিয়ন জোনাব আলী কে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। লোকোসেড এলাকা থেকে ০৮জন যুবককে আটক করে তাদের মধ্যে ছিল মনজুর মোর্শেদ বাদশা,মোঃ জালাল মিয়া,শ্যাম,আরমান,ইয়াদুর রহমান,খাইরুজ্জামান আখতার (তোতা মিয়া) এদের জিপে তুলে পাকবাহিনী ফরিদপুরের উদ্দ্যেশে রওনা হয়। পাক হানাদার বাহিনীর গাড়িতে একজন মাত্র বন্দুকধারী সেনা সদস্য ছিল। আলাদিপুর মোড়ে গিয়ে গাড়িতে থাকা সেনাসদস্য বাদশাকে জিপ থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এ সময় গাড়িতে থাকা অন্য বন্দিরা গাড়ি থেকে পালানোর ইঙ্গিত করে সেনাসদস্যেও বুকে লাথি মেরে দৌড় দেয়। শ্যাম ও তোতা মিয়া কোনমতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা জিপে থাকা বাকিদের কে ফরিদপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের জুন মাসে তৎকালীন রাজবাড়ী পৌরসভার চেয়ারম্যান হবিবর রহমানের বাড়ীতে প্রবেশ করে তার ছোট ভাই আফে, তার আত্বীয় আতাউর রহমান আর এক আত্মীয় আতা মিয়া এই তিন জনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে।

রাজবাড়ী থানা দখলে ২১ শে এপ্রিলের পরে মে মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারত যায়। জুন-জুলাই মাসে অনেকে ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্র সহ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। প্রথমত গেরিলা যুদ্ধ হয় পরে হিট অ্যান্ড রান। এটাই হলো গেরিলা যুদ্ধে সেনা সদস্যদের কে ব্যস্ত রাখার একটা রণকৌশল। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে অনেক জায়গায় সম্মুখ সমরে বড় ধরনের যুদ্ধ বাধে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে ১৪ ডিসেম্বর থানা নিজেদের দখলে নেয়। ১৮ই ডিসেম্বর রাজবাড়ী সদর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে অনেক অবাঙ্গালি বিহারী রাজাকার-আলবদর নিহত হয় এবং বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন আরো৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। রাজবাড়ী সদর উপজেলায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি শান্তি কমিটি রাজাকার ও অবাঙালি বিহারীদের তৎপরতা এতই তীব্র ছিল যে ১৬ ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করলেও রাজবাড়ী তখনও সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। বিজয় দিবসের পরেও ২দিন অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত যুদ্ধ করে সম্পুর্ণ হানাদার মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ী শহর ও আশেপাশের গ্রামে বাঙালি মুসলমান সহ হিন্দু নারী পুরুষ নিধন করা হয়। কারন রাজবাড়ী বিহারী মুসলমান অধ্যূষিত এলাকা ছিলো। রাজবাড়ী প্রধান শহর নিউ কলোনী, লোককলোনী আটাশকলোনী রেলকলোনী দ্বারা বেষ্টিত রাজবাড়ী শহর। বিহারী মিলিশিয়া আলবদর, রাজাকার স্থানীয় গ্রাম গুলি অলি গলি বাঙালি মুসলমান হিন্দুদের বাড়ী ঘর তারা চিনত।

এই কারণে বিহারীরা ৪/৫ জন করে গ্রুপ করে অস্ত্র নিয়া গ্রামে গিয়া সাধারণ নিরীহ মানুষদের ধরে আনত তার পর তাদের হত্যা করা হইত। ১৯৭১ সালে মার্চ মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর ১৮ তারিখ পর্যন্ত হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ছিলো।

এখানে আরও একটি সমীক্ষায় দেখা যায় হত্যাকান্ড হয় রাজবাড়ী রেল জংশন হওয়ার কারনে। রাজবাড়ী হয়ে যে সকল রেলগাড়ী আসা যাওয়া করত প্রতিদিন রেলগাড়ী থেকে লোকজন ধরে এনে হত্য করা হত। যে সকল ট্রেনগুলি আসা যাওয়া করত যেমন ভাটিয়াপাড়া আপ এন্ড ডাউন দুটি। ৬১ আপ খুলনা টু গোয়ালন্দ ৬২ আপ এন্ড ডাউন গোয়ালন্দ টু খলনা ৭৩ আপ দর্শনা টু গোয়ালন্দ ৭৪ ডাউন গোয়ালন্দ টু দর্শনা ৫৪ আপ চিলিহাটি টু গোয়ালন্দ ৫৫ ডাউন গোয়ালন্দ টু চিলিহাটি ট্রেনগুলি ১৯৭১ সালে প্রতিদিন এই জংশন হয়ে আসা যাওয়া করত ট্রেন থেকে বাঙালি হিন্দু/মুসলমানদেরকে ধরে এনে বিভিন্ন টর্চার সেলে রেখে হত্যা করা হত। হত্যার নায়ক ছিলেন সৈয়দ খামার, আব্দুর রব মাষ্টার, আলাউদ্দিন, আজহার আলী, ইফতেখার, জব্বার মিয়া, আকুয়া রহমত উকিল। দ্বিতীয় গ্রুপঃ- ইউনুছ, সামসু, শামীম, জাহাঙ্গির, বর কালুয়া, ছোট কালুয়া, সরফরাজ, দিলশাদ, ভুলুয়া, আতাউল, মোস্তফা নাম না জানা আরো অনেকে এরাই রাজবাড়ীতে হত্যযজ্ঞ চালিয়ে ছিলো। এরাই ছিলো হত্যার মাষ্টার মাইন্ড। অবাঙ্গালি বিহারীরা রাজবাড়ীর আলবদর মিলিশিয়া তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। রাজবাড়ী শহরের লোকসেড বিহারী কলোনি, নিউকলোনী, ২৮ কলোনী ছিল অবাঙ্গালি বিহারিদের প্রধান ঘাঁটি। তারা মাইক দিয়া বলতে শোনা যায় যে রাজবাড়ী পাকিস্থান রাহেগা বাংলাদেশ নেহি হোগা।

রাজবাড়ীর সব এলাকার বিহারিরা ইতিমধ্যে রেলওয়ে নিউকলোনিতে ও লোকোশেড কলোনিতে একত্রিত হয়ে বাঙ্কারে বাঙ্কারে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করার জন্য ঘোষণা দেয়। সারা দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও রাজবাড়ী পাকিস্তানি থাকবে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের অহংকার চূর্ণ করার জন্য প্রস্তুত হয়।

১৪ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ কমান্ডার বাকাউল আবুল হাশেম তার বাহিনী ও আব্দুল জলিলের বাহিনী নিয়ে এরেন্দা দত্তবাড়ি ক্যাম্প থেকে এসে রাজবাড়ী থানা আক্রমণ করে। তারা রাজাকার মিলিশিয়া ও অবাঙ্গালিদের কবল থেকে বাঙালী পুলিশদেরকে মুক্ত করে বিপুল পরিমাণ রাইফেল এলএমজি ও গুলি (কাটিজ) নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। বিহারিরা বুঝতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা এখন সামনা সামনি যুদ্ধ চালাবে তাই বিহারের রাজবাড়ী রেলগেট ১ নং লাইনে মালগাড়ি দ্বারা করিয়ে পূর্ব-পশ্চিম ভাবে দ্বার করিয়ে দেয়। বিহারীরা উত্তর পাশে বাজারের দিক দখল করে দক্ষিন মুখ করে গাড়ির চাক্কায় আর নিয়ে পজিশন নেয়। আর মুক্তিযোদ্ধাগণ দক্ষিন, পূর্ব ও উত্তর পাশ নদির দিক ০৩ পাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন চালায় বিহারী আলবদর রাজাকারের উপরে। ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, তারিখ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা মরণপন যুদ্ধ চালিয়ে বিরোধী পাকিস্তানী বাহিনী সহ রাজাকার মিলিশিয়া আলবদর অবাঙালী বিহারীদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়।

এযুদ্ধে অনেক হতাহত হয় ১৮ তারিখ মুক্তিযোদ্ধাগণ বিজয় উল্লাস করে নিজ বন্দুক থেকে আকাশে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে মুহমুহ জয় বাংলা স্লোগানে ধ্বনি তুলে আনন্দ উল্লাস করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা
যুদ্ধকালীন কমান্ডার
বাকাউল আবুল হাসেম, যুদ্ধাহত
মোবাইলঃ ০১৮২৪-৬৭২৮৬০।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com