শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন

আলোকিত মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বারের ৭৩তম জন্মদিন আজ

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২
  • ৩৪৮ Time View

আলোকিত মানুষ রাজবাড়ী জেলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ত্রাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বার এর আজ ৭৩তম জন্মদিন। ১৯৫০ সালের ৮ জুন তৎকালিন গোয়ালন্দ মহাকুমার গোয়ালন্দ ঘাট থানার উত্তর উজানচরে ঐতিহ্যবাহী ফকীর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ব্যবসায়ী পিতা ফকীর আমির উদ্দিন ও মাতা জালিমুন্নেছার ২য় সন্তান ফকীর জব্বার বাল্যকাল থেকেই দুরন্তপনা আর নিরণ্য ভুখানাঙা মানুষের আস্থার প্রতিক। রবি ঠাকুর তার জন্ম দিবসের আলিঙ্গনে লিখেছিলেন “জন্ম দিন আসে বারে বারে / মনে করাবারে / এ জীবন নিত্যই নূতন/ প্রতিপাতে আলোকিত/ পুলকিত দিনের মতন”।

রবী ঠাকুরের এই মর্মবাণীর প্রেক্ষিত আজ ফকীর আব্দুল জব্বার এর কর্মময় জীবনকে নূতনের আবিরে আলিঙ্গন করেছে। ১৯৬৪ সালে গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল ক্যাপ্টেন ও স্কাউট কমান্ডার থেকে সমাজ সংস্কারের যে উদ্ভাবনী চেতনায় জড়িয়ে ছিলেন সেই ¯্রােতের গতিপথ স্থুল না হয়ে ক্রমশঃ আরো বিস্তৃত শাখায় আজো রূপান্তরিত হচ্ছে। ১৯৬৮ সালের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সর্বোচ্চ ছাত্র নেতৃত্ব গ্রহণ ১৯৬৯ এর গণ অভূত্থানে বৃহত্তর ফরিদপুরের ছাত্রনেতা হিসেবে নেতৃত্ব দান, ১৯৭০ সালে রাজবাড়ী কলেজের ভিপি নির্বাচিত হওয়া এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে ১৭ এপ্রিল গোয়ালন্দ ঘাট হানাদার প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া সবই তার কীর্তি। দীর্ঘ নয় মাসের রণাঙ্গনের বিভীষিকাময় স্মৃতি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাশে থেকে যুদ্ধরত চাচা ফকীর মহিউদ্দিনকে হারোনো, মৃত্যুর আগেই মিলাদ হয়ে যাওয়া, কলকাতার কল্যাণী ক্যাম্পের আবেগঘন প্রশিক্ষণের সমাপ্তি টেনে নিজ এলাকা তথা মহকুমার মুজিব বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব কাধে নিয়ে ফিরে আসা, বিভিন্ন অঞ্চল মুক্তকরণে জীবন বাজি রাখা সবই এই আঞ্চলিক নায়কের পুলকিত দিনের প্রতিচ্ছবি।

সদ্য স্বাধীন মাতৃভূমিতে বুকভরে নিশ্বাঃস নেয়ার প্রশান্তি আর স্বজনের সাথে দীর্ঘ বিরতির সাক্ষাৎ দিয়েই পরিসমাপ্তি হয়নি এই বীরযোদ্ধার। জাতির পিতার দেশ গঠনের ডাক কানে আসতেই শুরু হয় তাঁর নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। মহকুমার সর্বত্র শ্রুতি ছিল গোয়ালন্দ থানা নদীভাঙন কবলিত নিরক্ষর এক নিরন্য জনবসতির নাম। সেইখানে কিভাবে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলটাকে শিক্ষা ও উন্নয়নের ছোয়ায় জড়িয়ে ফেলা যায় এই ভাবনা আছড়িয়ে ফেলছিলো ফকীর আব্দুল জব্বারের মন ও মননকে। উচ্চ শিক্ষিত ফকীর জব্বার শিক্ষা বিস্তারটাকেই বেছে নিলেন ঘুরে দাড়ানোর প্রথম স্তর হিসেবে। সেই প্রেক্ষিতেই ১৯৭২ সালেই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য “পূর্ব উজানচর হাবিল মন্ডল পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়” এবং নারী শিক্ষা উন্নয়নের জন্য “শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন সরকারি। বিনা পয়সায় যোগ্য শিক্ষক পেলেন না অবশেষে নিজেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আসলেন। পাশাপাশি গোয়ালন্দের মানুষের দেশ ও জাতির খবরাখবর পেতে পত্রিকার এজেন্ট হয়ে এবং সহজে বই পাওয়ার জন্য একটি লাইব্রেরী চালু করলেন। সেই থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মহকুমা শিক্ষক সমিতির সভাপতি হয়ে ইদ্রিসিয়া ইসলামীয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা বোর্ডেরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

থেমে যাননি তিনি কখনো, ছুটেছেন অবিরাম সমাজ বিনির্মাণে। ১৯৮৪ সালে ১মার্চ গোয়ালন্দ মহকুমা নাম পরিবর্তণ হয়ে রাজবাড়ী জেলায় রূপান্তরিত হলে ১১৩ বছরের হাজারো ইতিহাসখ্যাত গোয়ালন্দ সামান্য উপজেলায় পরিণত হয়। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রিয় সিদ্ধান্তে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আঞ্চলিক উন্নয়নের অংশিদারিত্বে অংশগ্রহণের জন্য গোয়ালন্দবাসির অনুরোধে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালনকালিন ৫ (পাঁচ) বছর সময়ে অনুন্নত ও নদী ভঙ্গুর গোয়ালন্দে নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্টসহ নানাবিধ উন্নয়ন সাধিত হয়েছিলো।
১৯৮৫ সালেই পিছিয়েপড়া নিরন্য মানুষের আশা আকাঙ্খার দীপ্ত স্লোগানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা (কেকেএস)” যার শপথ ছিলো “বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমরা আছি একসাথে”। সেই থেকে কেকেএস নীড় হারা, দারিদ্র মানুষের ভরসাস্থল আর দিশেহারা ও পরিচয়হীন শিশুদের দুর্বিসহ গ্লানি মোছার আশ্রয়স্থল। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন আর দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন মানবিক এক অধ্যায়ে শানিত করেছে এই সংগঠনের কর্তব্যে। জেলা প্রশাসন তাঁকে স্বীকৃতিস্বরূপ উপাধি দেন । “একজন আলোকিত মানুষ ফকীর আব্দুল জব্বার”!

উচ্চশিক্ষার কোন কলেজ ছিলোনা গোয়ালন্দ উপজেলায়। আত্মচেতনার বোধে ১৯৮৬ সালে স্থানীয় যুবসমাজকে সাথে নিয়ে উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত গোয়ালন্দে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম কলেজ “কামরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়”, যা এখন সরকারি। পরের বছরই প্রতিষ্ঠা হয় গোয়ালন্দ কারিগরি বিদ্যালয় যা পরবর্তিতে আইডিয়াল হাই স্কুল নামে গোয়ালন্দে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়াও শিক্ষা অধিকার বঞ্চিত ব্রোথহেল শিশু ও আদিবাসি শিশুদের জন্য কেকেএস শিশু বিদ্যালয়, বালিয়াকান্দি, কালুখালি ও রাজবাড়ী সদরের বেলগাছিতে আদিবাসি শিশু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিশুদের শিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশে আজীবন কর্মী ফকীর জব্বার স্বীকৃতি পেয়েছেন জাতীয় শিশু অধিকার ফোরামে। তিনি জাতীয় এই সংগঠনের বোর্ড মেম্বার। উন্নয়নে এভাবেই এক এক করে আরো ২১টি শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। তার সর্বশেষ সৃষ্টি “দৈনিক আমাদের রাজবাড়ী”নামক স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা।

অত্যন্ত মানবিক ও বিনয়ী ফকীর আব্দুল জব্বার ১৯৭৮ সাল থেকে বিশ্ব মানবতার একমাত্র ত্রাতা সংস্থা ‘বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি’র রাজবাড়ী জেলা সংগঠনের সাথে জড়িয়ে আছেন জাতীয় বোর্ড সদস্যসহ জেলার প্রধান বা চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সংস্থার মাধ্যমেও সমগ্র রাজবাড়ী জেলাতে অসহায় মানুষের জন্য দিয়েছেন মানবিক সেবা। গড়েছেন রেড ক্রিসেন্ট ভবন ও রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংক।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরণ অংশীজন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনকের আদর্শে আজো দীপ্তমান। ১৯৮৬ সালে জেলা কৃষক লীগ এর আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন থেকে জেলা পর্যায়ের রাজনীতিতে তার যে ভূমিকা শুরু হয়েছিলো জেলা আওযামী লীগ এর যুগ্ম সম্পাদক হয়ে বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট নেতা ফকীর আব্দুল জব্বারকে বেশী সমৃদ্ধ করেছে যে, তিনি সুস্থ থাকাকালিন কেন্দ্র ঘোষিত কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকেননি।এই রাজনৈতিক ভক্তি ভালোবাসা আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি গভীর অনুরাগ ও সার্বক্ষনিক যুক্ত থাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মানবতার মা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে ২০১৬ সাল থেকে রাজবাড়ী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত ও মনোনীত করে সম্মানিত করেছেন। রাজবাড়ী জেলার ৩টি পৌরসভা ও ৪২টি ইউনিয়নে জেলা পরিষদের বিগত ৬ (ছয়) বছরের উন্নয়ন অন্যান্য জেলার কর্মসূচিকে ঈর্ষান্বিত করেছে।

সমাজ বিনির্মাণের যোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বার বিগত ৩৫ বছর যাবৎ ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেমিনার সভা লিফলেট বিতরণ করে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সব পর্যায়ে আলোরণ তুলেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা’র ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণে তিনি এই জেলায় সর্বদা মাঠ সংগঠক। একজন দায়িত্বশীল মানুষের এই ভূমিকা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ দিনের আকাঙ্খার প্রতিফলন।

পারিবারিক অবয়বেও সমৃদ্ধ ফকীর আব্দুল জব্বার তিন সন্তানের জনক। স্ত্রী শরিফা বেগম (অবঃ) সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বড় সন্তান ড. ফকীর শহিদুল ইসলাম সুমন কলকাতা রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। দ্বিতীয় সন্তান শামিমা আক্তার মুনমুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে ডাঃ আবুল হোসেন কলেজে অধ্যাপনা করছেন। তৃতীয় সন্তান ফকীর জাহিদুল ইসলাম রুমন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে কেকেএস এর সহকারী নির্বাহী পারিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।

অনেক আড়ম্বরণের আলিঙ্গনে ঐশ^র্য্যমন্ডিত জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান আজ বয়সের ফ্রেমে প্রবীণ। কিন্তু তাঁর মনে এখনো উদ্দিপ্ত সমাজ বদলের চেতনা শত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে গেছে। তিনি নিজেকে এক জন উন্নয়নকর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর ব্যক্ত কথায় তারই প্রতিফলন। তিনি প্রায়শঃই বলে থাকেন এভাবে “আমি স্বপ্ন দেখি, ঘুমিয়ে নয় জেগে। আমি অনাগত শিশুদের জন্য স্বপ্ন আঁকি নিরবে নয় স্বশব্দে। আমি স্বপ্ন দেখাই তাদেরকে যারা হতাশা কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চায় লক্ষিত মোহনায়”।

মহান এই মহীরূহের ৭৩তম জন্ম দিনে তার প্রতিষ্ঠিত ও দায়িত্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে শুভ কামনা। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা রণাঙ্গনের এই কীর্তিমান বীরের সর্বস্বীকৃত মানবিক প্রতিষ্ঠান ‘কেকেএস’ ও তাঁর সর্বশেষ সৃষ্টি ‘দৈনিক আমাদের রাজবাড়ী’ দীর্ঘায়ু কামনা করছে। আমরা সকলেই সমস্বরে বলি “শুভ জন্ম দিন ফকীর আব্দুল জব্বার, জয়তু ফকীর আব্দুল জব্বার” শ্রষ্টা আপনাকে আমাদের জন্য আরো দীর্ঘ জীবন দান করুন। আমিন॥

শুভ কামনায়
কেকেএস ও দৈনিক আমাদের রাজবাড়ী পরিবার।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com