শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৪ অপরাহ্ন

বাঙালির বর্ণাঢ্য ঈদ উৎসব: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : রবিবার, ১৬ জুন, ২০২৪
  • ৬৩ Time View

বাঙালির বর্ণাঢ্য ঈদ উৎসব: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
শ ম রশীদ আল কামাল

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর ঈদ পালনের রীতি-নীতি চালু হয়। মুসলমানরা প্রথম ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করে হিজরি ২য় সনে। ইংরেজি সাল গণনায় ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের শেষের কোন একটি দিনে দিনটি পালন করা হয়।

এদিন নবী মোহাম্মদ (সা:) ছোট-বড় সবার সঙ্গে ঈদ আনন্দের সময় কাটাতেন। মদিনার ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের সঙ্গে বিশ্ব নবী মোহাম্মদ (সা:) ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতেন। তিনি শিশু-কিশোরদের শরিয়তের অন্তর্ভূক্ত সব ধরণের আনন্দ করার অনুমতি দিতেন। হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত পবিত্র হাদিস গ্রন্থ সুনানে আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে- মহানবী (সা:) যখন মদিনায় আগমন করেন তখন তাদের দু’টি দিন ছিল; যাতে তারা উৎসব পালন করত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এ দু’টি কিসের দিন? তারা বলেন, আমরা জাহেলীযুগে এই দুই দিন খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব পালন করতাম। এ নিয়মই চলে আসছে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন- “মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দুইটির পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন। তাহলো ঈদুল ফিতরও ঈদুল আযহা” (হাদিস- নাসায়ি: ২০২১, মিশকাত: ১৪৩৯)

ঈদের দিন মহানবী (সা:) সকালে গোসল করে সুগন্ধি মেখে উত্তম পোষাক পরিধান করে ঈদগাহে এ যাওয়া-আসার ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করতেন। ঈদগাহে গিয়ে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। নামাজ শেষে তিনি মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে খুতবা পাঠ করতেন। গরীব-দুঃখীদের খোঁজ খবর নিতেন। ছোটদের ভালবাসতেন। আমাদের এ দেশে কীভাবে ঈদ উৎসবের প্রচলন শুরু হয়েছে তার ইতিহাস ও সঠিকতথ্য খুব একটা জানা যায়নি। নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র ও তথ্যথেকে রোজা পালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আযহা উদ্যাপনের যে ইতিহাস জানা যায়। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের মতে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদ উৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। কেননা বঙ্গদেশে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সূফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ববাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব পূর্ববাংলায় এসে পড়েছিল। ঈদ উৎসবের সূচনাও ঐ প্রক্রিয়াই হয়েছে বলে তার মত।

ইতিহাসবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন যে, দেড়শ বছর আগেও এ অঞ্চলে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোন উৎসব ছিলনা। তাঁর মতে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সময় বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদ্যাপনের চল শুরু হয়। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন- তার আগে মুসলমান ছিলেন অনেক কিন্তু তাদের রাজনীতির মধ্যে লোকায়ত ধর্মের মিল ছিল বেশি। যে কারণে ওই সময় ঈদ উদ্যাপনের তথ্য তেমন পাওয়া যায় না। রাজধানী শহর ঢাকার (১৬০৮) প্রতিষ্ঠার পর এখানে মোঘল শাসক, ঢাকার নবাব, অভিজাত ধনিক-বণিক সম্প্রদায় এবং আদি ঢাকাবাসীর বার্ণঢ্য ঈদ উদ্যাপনের পরিচয় পাওয়া যায়। মূলতঃ মুসলমানরা ঢাকায় এসেছিল ১৬১০ সালে। তখন তাদের পাঠানো নায়েব-নাজিমরা ঈদ উদ্ধযাপন করতেন। অধ্যাপক মামুন বলেন- “ঈদের চাঁদ উঠলে তারা আনন্দ-উৎসব শুরু করতেন, কামানদাগা হত। ঈদের দিন তারা একসঙ্গে নামাজ পড়তেন। নামাজ পড়ে ফেরার পথে হাতি বা ঘোড়ার পিঠ থেকে তারা সাধারণ মানুষের দিকে পয়সা ছুড়ে দিতেন। ঈদ তাদের নিজেদের মধ্যেই উদ্যাপিত হত, সাধারণ মানুষের সাথে তার সংযোগ ছিল না। নব্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ঈদ উৎসবকে সর্বজনীতা জ্ঞান করে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এবং আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে রেকর্ড করা ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ ১৯৪০ এর দশক থেকে শুরু হয়ে বাংলার ঈদ উৎসব ধীরে ধীরে ধর্ম-সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসাবে বৃহৎ থেকে বিশাল আবর্তনে রূপান্তরিত হচ্ছে। তৎকালীন পূর্ববাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে বিত্তহীনতা ও নগদ টাকার অভাব থাকায় দরিদ্র কৃষি পরিবারে ঈদ উৎসবের কোন ধুমধাম ছিল না। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলের শেষ দিকেও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের যারা শহরে চাকুরি করতেন বা ছোটখাটো ব্যবসা বা ওকালতি করতেন তাঁদের বাড়িতে ঈদের দিনের খাদ্য তালিকায় পোলাও, কোরমা, জর্দার দেখা মিলত। তাঁদের সন্তান-সন্তাতিরাও ভালো কাপড়-চোপড় পেত মা-বাবার কাছ থেকে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক দেহাতি মানুষ প্রায় ভুখানাঙ্গা অবস্থায়ই ঈদের দিনটি অতিক্রম করেছে। জাকাতের দান-খয়রাত, মসজিদের শিরনি বা অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি থেকে দেওয়া কিছু ভালো খাবারই ছিল তাদের ঈদের দিনের সম্বল। বাংলার মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার (১২০৪) অনেক আগেই পূর্ববঙ্গে ইসলাম প্রচারের অনুসঙ্গে নামাজ, রোজা ও ঈদ উসৎবের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৩৭-৪০ এ শেরে বাংলা, নজরুল, আব্বাস উদ্দিনের রাজনীতি, সাহিত্য ও সংগীতে তাঁর সূত্রপাত। আর ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন উন্নয়নশীল বাংলাদেশে নগর উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের বিপুল বিস্তার এবং নগদ অর্থবিত্তের সমাগমে ঈদ উৎসব একপ্রধান বর্ণাঢ্য ও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বাঙালি মুসলমানদের সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসব ঈদ। অন্য কোনো জাতীয় দিবসের সাথে এর তুলনা চলে না। মুসলমানদের দু’টি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। একমাস রোজা পালনের পর পহেলা সাওয়াল ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। এর দুই মাস দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। ঈদ শব্দটি যার অর্থ হলো ভাবগম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। ঈদ নামকরণ করা হয়েছে একারণে যে তা প্রতি বছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আপনাদের কাছে ফিরে আসে। আরবীতে ঈদুল আযহা অর্থ হচ্ছে আত্মত্যাগের উৎসব। এবারের ঈদ উৎসব ও পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ একই সঙ্গে বাঙালিদের সার্বজনীন প্রাণের উৎসবে প্রখন অনুজ্জ্বল থেকে ক্রমে ক্রমে অতুৎজ্জ্বল মহিমায় অভিষিক্ত।
তথ্যসূত্র:
 শামসুজ্জামান খান, সেকালের বাঙালির ঈদ উৎসব, প্রবন্ধ: প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল২০২৩
 সামান্তা সাইদ খান, বিশে^ যেভাবে শুরু হয়েছিল ঈদ উৎসব উদ্যাপন, বিবিসিনিউজ, ১ মে ২০২২
 মুফতি আব্দুল আজিজ, ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ঈদ। প্রবন্ধ: ২১ এপ্রিল ২০২৩

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com