রাজবাড়ী জেলাকে যদি অন্য কোন জেলার সাথে তুলনা করা হয় তা হলে শিল্প,সাহিত্য সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকবে।
বিজন ভট্টাচার্য রাজবাড়ী জেলার খানখানাপুরে ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। ভূস্বামী পরিবারে তার জন্ম। পিতার কর্মসূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার সুবাদে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন।
রাজবাড়ী জেলাকে যারা আলোকিত করেছেন তাদের মধ্যে বিজন ভট্টাচার্য একজন। বিজন ভট্টাচার্য সম্পর্কে সুবীর বসু লিখেছেন, ‘… একবার হয় রঙ্গনা নয়তো বিজন থিয়েটারে ‘চলো সাগরে’ নাটকের অভিনয় শেষ হয়ে গেছে। সকলে মেক আপ, জামা কাপড় পাল্টাচ্ছে। বিজনকাকা হঠাৎ হাউ হাউ করে কাঁদছেন আর বলছেন আমরা তো নাটকে ইন্টারন্যাশনাল গাইছি। কিন্তু কবে তা আমাদের দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গাইবে? আমরাই কি কেবল গেয়ে যাব?’ তাঁর নবান্ন নাটকের মধ্য দিয়েই সূচনা হয় গণনাট্য আন্দোলনের। এই আন্দোলনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পতাকার নীচে জড়ো হন বিজন ভট্টাচার্য-সহ শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, শম্ভু ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহানি, ভীষ্ম সাহানি, রবিশংকর প্রমুখ প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিক।
গণনাট্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করা এবং তাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সহায়তা করা। অনতি-পরবর্তী যুগের নবনাট্য এবং বর্তমান যুগের গ্রুপ থিয়েটারের জন্ম এই গণনাট্য আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ ফল।
বাংলা নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে নাট্যকার অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তৃতীয়ত, বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসেও বিজন ভট্টাচার্যের অবদান অনস্বীকার্য।
বিজন ভট্টাচার্য নাটককে যিনি কেবল একটা ‘পারফর্ম্যান্স’ হিসেবে দেখতেন না। শিল্প বলতে বুঝতেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। থিয়েটারকে বুঝতেন জন গণের নাটক। যা কেবল সাধারণ মানুষের ভাল-মন্দ-দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বলবে না। নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষও হয়ে উঠবেন সেই গল্পের এক-একজন কুশীলব। দর্শক এবং রঙ্গকর্মী সকলে একত্রে ঢুকে পড়বেন থিয়েটারের অঙ্গনে। তার পরে বিপ্লব ঘটে যাবে। জীবন, রাজনীতি এবং থিয়েটার নিয়ে এ ভাবেই মিলেমিশে ছিলেন বিজন। কোনও একটি সত্তাকে বাদ দিয়ে তাঁর অন্য সত্তাকে বোঝা মুশকিল।
যাপন-অর্থনীতি-রাজনীতি-পরব— সব নিয়ে মাখামাখি যিনি, তিনি নিজেই আসলে একটা থিয়েটার! মোনোলগ।ভারতীয় গণনাটকের প্রথম স্রষ্টা’ বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকটি দেখে ইংরেজ সৈনিকদের অন্যতম বৈমানিক বিল বাটলার উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি আবেগঘন চিঠি লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্যকে।
দেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকারের নীরবতায় ক্ষুব্ধ হয়ে সে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানবতাবাদী নাগরিকদের বিভিন্ন সংবাদপত্রে একের পর এক লেখায় প্রকাশ পেতে থাকে পরিস্থিতির নির্মমতার কথা এবং তারই ফলে সৃষ্ট ব্যাপক জনমতের চাপে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্স্টন চার্চিল বাধ্য হলেন ১৯৪৪-এর ‘দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশন’ গঠন করতে।
বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন তেমনি তেজী একজন নাট্যকার। বিখ্যাত লেখিকা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজয়ী মহাশ্বেতা দেবী বিজন ভট্টাচার্যের স্ত্রী। তবে পরবর্তীকালে তারা বিবাহ বিচ্ছিন্ন হন। তাদের এক সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য যিনি ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নবারুণ ভট্টাচার্য একজন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক এবং কবি।
বিশ শতকের চারের দশকের বাংলার গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে যখন শিশির ভাদুড়ি নাট্যজগৎ-কে শাসন করছিলেন, তেমনই এক সময়ে, ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন এবং ১৯৪৩-৪৪-এর দেশব্যাপী মন্বন্তরের পটভূমিতে বিজন ভট্টাচার্যের আবির্ভাব।।হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী প্রভাব থেকে থিয়েটারকে মুক্তি দিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন শ্রমজীবী ও নিচু স্তরের মানুষদের জীবন যাত্রার কথা।