রাজবাড়ী সদর উপজেলার নিভৃত পল্লি ভবদিয়া গ্রাম। এই গ্রামে এক একর জায়গার উপর গড়ে উঠেছে গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে পাট, কচুরিপানা, হোগলাপাতা, ধানের খড় দিয়ে তৈরি হয় প্রায় একশ ধরণের পণ্য। আর এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ২৬টি দেশে। প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত দুই হাজার শ্রমিক হয়ে উঠেছেন আত্মনির্ভরশীল।
জানা গেছে, ভবদিয়া গ্রামের বাসিন্দা হাকিম আলী সর্দার উদ্যোগি হয়ে ২০০৮ সালে ছোট পরিসরে গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর ব্যপ্তি আর শ্রমিকের সংখ্যা। ২০১৫ সালে এক একর জুড়ে ব্যাপক পরিসরে শুরু হয় এর কার্যক্রম। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে জীবন জীবীকা নির্বাহ করছেন কয়েকজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও। কারখানাটিতে বর্তমানে শ্রমিকের সংখ্যা আটশ জন। তবে বাড়িতে বসে ঘরের কাজের পাশাপাশি পাটজাত পণ্য তৈরি করছে এর সংখ্যা প্রায় ১২শ জন। এ প্রতিষ্ঠানটিতে তৈরি হচ্ছে নার্সারী পট, ফ্লোর ম্যাট, প্লেস ম্যাট, বিভিন্ন ধরণের ব্যাগ, ঝুরি, টিফিন বক্স, পেট হাউস, টিস্যু বক্স, ফাইল বক্স, ট্রে, ফুল ঝুরিসহ নানান পণ্য। এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে নেদারল্যান্ড, আমেরিকা, তুরষ্ক, সৌদি আরব, জাপান, হংকং, মালয়েশিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ ২৬টি দেশে।
এ প্রতিষ্ঠানে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তাদের বেশির ভাগই নারী। এক সময় যাদের দিন কেটেছে অর্থকষ্টে। এখানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। তেমনই একজন সদর উপজেলার হাউলি জয়পুর গ্রামের সালমা আক্তার। জানালেন, তার স্বামী একজন দিনমজুর। করোনার সময় তাদের পারিবারিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। দুই বছর আগে এ মিলে চাকরি নেন। এখন তার সাংসারিক অবস্থা খুবই ভালো। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারছেন। দুই একটা শখের জিনিসও কিনতে পারছেন। অভাব অনটন এখন আর নেই। একই রকম কথা জানালেন ময়না বেগম, নাজমাসহ কয়েকজন শ্রমিক।
গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টস এর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন রূপালী খাতুন। তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। জানালেন, সবার কাছে অবহেলিত ছিলেন তিনি। কখনও ভাবেননি কেউ তাকে কাজ দেবে। এখানে কাজ করে তিনি সাবলম্বী হয়েছেন। তার এখন আর কোনো চিন্তা নেই। নিজে কাজ করে খেতে পারছেন এটাই তার শান্তি।
গোল্ডেন জুট প্রডাক্টস এর সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আলাউদ্দিন সুজন জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ শ্রমিক নারী। বাড়িতে বসে কাজ করেও টাকা উপার্জনের সুযোগ তারা করে দিয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশে বিদেশে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলে খুবই ভালো হতো। বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর চালাতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়।
গোল্ডেন জুট প্রডাক্টস এর ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান ২০০৭ সালে সাভারে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হাকিম আলী সর্দারের নেতৃত্বে গোল্ডেন জুট প্রডাক্টস আজ এ পর্যায়ে এসেছে। শিল্প কলকারখানা সবাই শুধু ঢাকায় করার কথাই ভাবে। ২০১৫ সালের দিকে আমরা রাজবাড়ীতে জুট মিলটি করার চিন্তা করি। সেই ভাবনা থেকে এক একর জায়গা কিনে এই জুট প্রডাক্টসটির কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করি। এখানে এখন একশটির বেশি পাটজাত পণ্য তৈরি হয়। শুধু পাট নয়, হোগলা পাতা, ধানের খড় এবং কচুরিপানা দিয়েও পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। এসব পণ্য ইউরোপসহ বিশে^র ২৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে পাটের পণ্য সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা হতো তেমনি পাটচাষীরাও লাভবান হতে পারতো। পলিথিনের বদলে পাটের ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান বলেন, গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টসের কার্যক্রম খুবই ভালো। আমরা তাদেরকে প্রোমোট করছি। তাদের তৈরি পণ্য খুবই মানসম্মত।