‘রাজবাড়ী’ নামটি শুনলেই মনে হবে এখানে রাজার বাড়ি আছে। বাস্তবতা হলো শহরতলীর লক্ষীকোলে থাকা রাজার বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। তবে, জেলায় প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে এখনও রয়ে গেছে বেশ কিছু পুরাকীর্তি। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো এখন ধ্বংসের পথে। স্থানীয়রা এসব পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য জোর দাবি তুলেছেন। জেলা প্রশাসনও তাদের দাবির প্রতি সহমত প্রকাশ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজবাড়ী শহরে রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে লাল ভবন, সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বেলগাছিতে দোলমঞ্চ সানমঞ্চ, পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের মুকুন্দিয়ায় ৭০ ফুট উচ্চতার মঠ, বালিয়াকান্দির নলিয়ায় জোড়বাংলা মন্দির, নীলকুঠি, জঙ্গলে সমাধিনগর মঠ ইত্যাদি জেলার প্রাচীন নিদর্শন। যেসব এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে, যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া না হলে এসব স্মৃতিচিহ্নগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।
রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ১৮৭১ সালে মাইনর স্কুল দিয়ে যেটির যাত্রা শুরু তা পূর্ণ রূপ পায় ১৮৯২ সালে। ১৮৯২ সালে তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমার বাণিবহ স্টেটের জমিদার গিরীজা শংকর মজুমদার ও অভয় শংকর মজুমদার রাজবাড়ীর সজ্জনকান্দা মৌজায় দি গোয়ালন্দ ইংলিশ হাই স্কুল নাম দিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে গোয়ালন্দ মডেল হাই স্কুল এবং সর্বশেষ রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। কালের পরিক্রমায় পুরনো ভবনটির পাশে ও সামনে আরও তিনটি ভবন নির্মিত হয়। পরিত্যক্ত হয়ে যায় লাল ভবনটি। ২০১৩ ও ২০১৯ সালে দুই দফায় ভবনটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। দুবারই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের বাধায় সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে ভবনটি পরিদর্শন করে প্রতœতত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, রাজবাড়ীর এই লাল ভবনটি অসাধারণ একটি স্থাপনা। এর সাথে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। প্রতœতত্ব বিভাগ এ ধরনের স্থাপনা- যেগুলি একশ বছরের পুরনো এবং যে স্থাপনা ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করে থাকে আছে তা সংরক্ষণ করে থাকে। কিন্তু পরিদর্শন করে যাওয়ার পর সংরক্ষণের কাজ আর এগোয়নি। ২০১৯ সালে এই লাল ভবনটিকে অকেজো ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তখনও প্রাক্তন ছাত্রদের বাধায় আর সম্ভব হয়নি।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা বলছেন, রাজবাড়ীর ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত লাল ভবন। রাজবাড়ীতে শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে চালু হয়েছিল তারও স্মৃতি বহন করে লাল ভবনটি। এটি ইতিহাসের অংশ। শুধু আবেগের জায়গা থেকে নেয়, ইতিহাসের একটি ভিত্তিও রয়েছে। তারা লাল ভবনটি রক্ষার জোর দাবি করেন।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বেলগাছি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ২২২ বছরের পুরনো দোলমঞ্চ ও সানমঞ্চ। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নিদর্শন দুটি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আশেপাশে জমেছে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রচন্ড ঝড় উঠলে পদ্মা পাড়ে পানশী ভিড়িয়ে নাটোরের রাজা রামজীবন রায় এখানে আশ্রয় নেন। এলাকাবাসীর সেবায় তিনি মুগ্ধ হয়ে এ এলাকায় একটি মন্দির স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন এবং কাজও শুরু করেন। কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যু হলে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন তার পুত্রবধু রানী রাজভবানী। বাংলা ১২০৯ সালের (ইংরেজি ১৮০২ সাল) ১৩ আষাঢ় এই মন্দিরটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। মূল মন্দিরটির পাশেই রয়েছে দোলমঞ্চ ও সানমঞ্চ। চওড়া ইট আর সিমেন্টের গাঁথুনিতে তৈরি প্রাচীন নিদর্শন দটি এখন ভঙ্গুর প্রায়। প্রতি বছর শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে এখানে অনুষ্ঠিত হতো দোলপূজা। দোলমঞ্চের জৌলুস হারানোর সাথে সাথে উৎসবও হারিয়ে গেছে। দোলমঞ্চের উচ্চতা ১৫ ফুট আর প্রস্থ ১৮ ফুট। বেশ কয়েক বছর আগে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে এই মন্দিরটি সংস্কার এবং দোলমঞ্চ সানমঞ্চ (স্নানবেদি) রক্ষার আবেদন করা হয়েছিল। তারা পরিদর্শনে এসে যথাযথ পদক্ষেপের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর কিছুই হয়নি। এলাকাবাসী মন্দিরটি সংস্কার করে ঐতিহ্য রক্ষার জন্য জোর দাবি জানিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তারা বেশ কয়েকবার প্রাচীন এই নিদর্শন দুটি রক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তা আশ্বাসের পর্যায়েই থেকে গেছে। কাজ আর এগোয়নি। এখনও উদ্যোগ নিলে এ দুটি নিদর্শন রক্ষা করা সম্ভব।
চরম হুমকির মুখে রয়েছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের মুকুন্দিয়ায় ৭০ ফুট উচ্চতার একশ বছরের পুরনো মঠটি। ইতিমধ্যে বড় মঠটির পাশে থাকা ছোট মঠটি ভেঙে পড়ে গেছে। রাজবাড়ী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মুকুন্দিয়ায় গিয়ে জানা যায়, এই গ্রামে আনুমানিক একশ বছর আগে তৎকালীন জমিদার দ্বারকানাথ সাহা চৌধুরীর ছেলে ষড়জেন্দ্রনাথ বাবু তার মা-বাবার স্মৃতির উদ্দেশে দুটি মঠ তৈরি করেন। পরবর্তীতে কোনো এক সময় জমিদারের উত্তরসূরীরা সবকিছু ফেলে সপরিবারে ভারত চলে যান। থেকে যায় দুটি মঠ ও মঠ সংলগ্ন প্রায় সাত একর জমি। এসব জমি চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে। মঠের সামনে ও পেছনের অংশের দুই দিকেই খাল। মঠে যাওয়ার জন্য রয়েছে একটি সরু রাস্তা। মঠের ভেতর ও আশেপাশে ময়লা-আবর্জনা এবং লতা-পাতায় ভরা। মঠটির ওপরে জন্ম নিয়েছে ছোট-বড় আগাছা। মঠটি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আবেদন জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বালিয়াকান্দি উপজেলার নলিয়া গ্রামের জোড় বাংলা মন্দিরটি সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৩ শত বছর আগে ১৬৫৫ সালে রাজা সীতারাম রায় তার ইচ্ছা অনুসারে একটি সোনার মূর্তি দিয়ে দুর্গাপূজা করতে চেয়েছিলেন। নলিয়া গ্রামের এক কর্মকারকে মূর্তি বানাতে বলেন। সেই কর্মকার রাজা সীতারাম রায়ের কাছে স্বর্ণ চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই কর্মকার স্বর্ণ চুরি করতে পারে এমনটি ভেবে রাজা তাঁর বাড়িতে গিয়ে মূর্তি বানাতে বলেন। রাজার এই কথায় কর্মকার মনে কষ্ট পেয়ে রাজার বাড়িতে গিয়ে সোনার মূর্তি পাশাপাশি আরেকটি পিতলের মূর্তি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় রীতিতে এক মন্দিরে দুই পূজা না করার বিধি থাকায় তখন রাজা ওই কর্মকারকে পিতলের মূর্তিটি তাঁর নিজ বাড়ি নলিয়া গ্রামে স্থাপন করে সেখানে পূজা করার নির্দেশ দেন এবং মন্দিরটি রাজা নিজে স্থাপন করে দেন। সেই থেকেই সৃষ্টি হয় নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির। অযতœ আর অবহেলায় মন্দিরটি এখন বিলুপ্তির পথে। দীর্ঘদিন কোন সংস্কার না হওয়ায় মন্দিরটি তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে।
মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দ জানান, রাজা সীতারাম রায়ের আমলে এই মন্দিরটি স্থাপিত হয়। এখানে মন্দিরের নামে এখনো ৩১ শতাংশ জমি রয়েছে। এর বেশির ভাগ জমিই এখন বেদখল হয়ে গেছে। জোড়বাংলা মন্দিরটি সংস্কার না করায় ধ্বংসের পথে। তিনি প্রাচীন এই নিদর্শনটি রক্ষার জোর দাবি জানান।
এছাড়া এ উপজেলায় রয়েছে একটি নীলকুঠি। যেটি উপজেলা পরিষদের পেছনে অবস্থিত। স্থানীয়রা জানান, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর নীলকরদের অত্যাচার যখন বৃদ্ধি পায় তখন প্রজা সাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে সংঘবদ্ধভাবে নীলকরদের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় নীলবিদ্রোহ। রাজবাড়ীতেও নীলবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। বালিয়াকান্দির শত শত চাষী নীলকর ও জমিদারদের বিরূদ্ধে নীল বিদ্রোহে অংশ নেয়। বহু স্থানে নীলকুঠি আক্রমণ করে ও কাচারী জ্বালিয়ে দেয়। তারই নিদর্শন নীলকুঠি।
এ উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের শেকারা গ্রামে রয়েছে শাহ পালোয়ানের মাজার। ১৪৮০ থোেক ১৫১০ সালের মধ্যে শাহ পালোয়ান বোগদাদ শরীফ ত্যাগ করে এখানে বাসস্থান ও উপাসনালয় নির্মাণ করেন। তিনিই এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ভীত রচনা করেছিলেন। তাকে নিয়ে নানান অলৌকিক ঘটনার কথা প্রচলিত আছে।