সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন

শ্রাবণের ধারা -কামরুন্নাহার বিউটি (বীথি)

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : শনিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৫
  • ২৮ Time View

শ্রাবণের ধারা
কামরুন্নাহার বিউটি (বীথি)

গত তিন মাস যাবৎ শ্রাবণীর শরীর আস্তে আস্তে আরও দুর্বল হতে থাকে। তবে ওর মনের জোর এতোটা প্রবল ছিল যে, লিউকেমিয়ার মত এত বড় একটা কঠিন অসুখ তাকে ঘায়েল করতে পারে নি।

প্রায় এক বছর যাবৎ অন লাইনে অনেক শুভাকাক্সক্ষী হয়েছে তার, প্রত্যেকের সাথে সাবলীল ও স্বাভাবিক ভাবেই গল্প আড্ডা দেয় কেউ কখনও বুঝতেও পারে নি শ্রাবণীর কঠিন অসুখের কথা। শ্রাবণী চমৎকার আকর্ষণীয় একটি মেয়ে। প্রায় প্রতিটা মানুষ ওকে খুব খুব পছন্দ করে সেটা শ্রাবণী ভালোই বুঝতে পারে। তবে কথা হলো শ্রাবণীও তো একটা মানুষ তারও তো পছন্দ অপছন্দ বলে কিছু কথা থাকতে পারে।

শ্রাবণীর নিজের পছন্দ করা পাত্রের সাথেই তার বাবা মা, তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। স্বামীর সংসারে অত্যন্ত সুখি শ্রাবণী। দুই সন্তানের জননী। মনে পড়ে না বিয়ের পর কোন দিন নিজ হাতে নাস্তা তৈরী করে খেতে হয়েছে কিনা। কারন তার বর ‘ নিয়ম করে সকালে হাটতে বের হয় এবং হোটেল থেকে নাস্তা নিয়ে এসে নিজের হাতে শ্রাবণী ও বাচ্চাদের বসিয়ে খাওয়ায়। এমন কি দিনের যে কোন সময় কাজে কর্মে সাহায্য করে। বেশ হাসি খুশি আনন্দময় উচ্ছল প্রাণবন্ত সংসার শ্রাবণীর।

অন লাইনে, রবীউল হোসেন নামে এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয় শ্রাবণীর। মাঝে মাঝে হালকা কথা বার্তাও হয় তাদের মধ্যে। কথায় কথায় জানা হয় যে, ভদ্রলোক একা, নিঃসঙ্গ তার কেউ নেই। বিয়ের বছর তিন পরে মনি মুক্তা নামে দুটো জমজ মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে তাদের মা ” চিরতরে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সেই থেকে ভদ্রলোক একা নিঃসঙ্গ। মেয়ে দুটোরো বিয়ে হয়ে গেছে, তারাও যে যার শ^শুর বাড়ীতে। রবীউল হোসেনের দেখাশুনা করার মত তেমন কেউ পাশে নেই। ভদ্রলোকের একাকিত্ব নিঃসংগতা শ্রাবণীকে আহত করে। শ্রাবণী ছেলেবেলা থেকেই বেশ স্পর্শকাতর আর মায়াবী মনের মানুষ। শ্রাবণী যখন ছেলে মেয়ে ও স্বামীর সাথে সুখের সময় অতিবাহিত করে, ঠিক তখনই তার মনের অবচেতনে অবুঝ মনটা ভীষণ রূপে ব্যথিত থাকে যা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউই দেখে না। শ্রাবণীও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, পরক্ষনেই ভেবে নেয় ভুল কিসের “”আমি তো তাকে আমার করে পেতে চাই না। “”

তবে কেন কারো কষ্ট বেদনা আমাকে বার বার ছুঁয়ে যাবে। বেশ এর পর আর কোনদিন রবীউল হোসেনের সাথে কথা বলবে না শ্রাবণী মনে মনে ঠিক করে নেয়।

নিজেকে সংযত রাখে, না রেখেই বা উপায় কী?

শ্রাবণীও যে অসুস্থ সে কথা রবীউল হোসেন বা অন্য কোন বন্ধু বান্ধব কেউই জানে না।

ধীরে ধীরে শ্রাবণী এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, নিজের পরিবার ছাড়া কারো সাথেই আর যোগাযোগ রাখা হয় না। অন লাইনেও বসা হয় না। বাহির জগতের সকলের সাথেই এক প্রকারের যোগাযোগ সব বন্ধ হয়ে যায়। স্বামী, ছেলে মে ছাড়া সবার সাথেই দেখা পর্যন্তও প্রায় বন্ধ। নিজের মত করে একাই থাকে আর মনে মনে ভাবে কি হবে সকলের সাথে কথা বলে, একটু হাসি একটু ভালো থাকার আশায় তো সবার সাথে কথা বলা। সেও তো সবার ভালো লাগে না। তার চেয়ে এই ভালো একা থাকা, একা এসেছি, একাই তো চলে যাব। কেউ তো সাথে যাবে না, না গেছে কোন দিন। শ্রাবণীও জানে তার কঠিন অসুখের কথা এটাও জানে সময় বেশি নেই, এই অল্প সময় নষ্ট না করে মহান রাব্বুল আলামীন কেই ডাকা ভালো। তার সান্নিধ্য খুঁজাই ভালো তিনিই সব বাকি সব মিথ্যা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শ্রাবণী সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল এমন কি তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় রবীউল হোসেনের সাথেও।।

শ্রাবনীর শুভাকাক্সক্ষীরা ওর খোঁজ খবর না পেয়ে সবাই টেনশনে পড়ে যায়, এত প্রাণ চঞ্চল, পাহাড়ী ঝর্ণার মত উচ্ছল মেয়ে টির হঠাৎ কী হলো, না তাকে ফোনে পাওয়া যায়, না অন লাইনে, কোথাও তার কোন খবর নেই। ঐ দিকে রবীউল সাহেবও ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা বোধ করছেন, যে মেয়েটি প্রতিদিন নিয়ম করে আমার খোঁজ খবর আজ প্রায় তিন মাস তার কোন খবর নেই। কোন ভাবেই শ্রাবণীর কোন খোজ নিতে না পেরে, বাধ্য হয়ে শ্রাবণীর বরের ইনবক্সে খবর নেন।

অসাধারণ বড় মনের মানুষ শ্রাবণীর বর। সে জানায় শ্রাবণী এক মাস যাবৎ বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের ক্যান্সার বিভাগে ভর্তি আছে, কেমো চলছে। বাকি আল্লাহ্ র ইচ্ছা! শ্রাবণীর বর “ইমু হাসান “বলেন, আপনি রবীউল ভাই! শ্রাবণীর মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। সে সময় সুযোগ পেলেই আপনার গল্প করতো। আপনার সব কথা আমাকে জানাতো। সে আপনাকে অনেক পছন্দ করতো, ভালোমানুষ জানতো। এতো কথা হতো আপনাদের অথচ আপনি ওর অসুখের কথাটাই জানেন না। ইমু হাসান ইনবক্সে সব কথা লিখে জানালেন রবীউল সাহেবকে।

খুব অবাক হয়ে গেলেন রবীউল সাহেব। মনে মনে ভাবলেন, আমরা মানুষরা কতোটা অসহায়। একে অপরের সাথে কত কথা বলি, অথচ নিজে থেকে কিছু খুলে না বললে বুঝতেও পারি না ভিতরের সমস্যা।

রবীউল সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন আর দূরে থাকা নয়, এবার থেকে শ্রাবণীর খুব খুব কাছের একজন আপন মানুষ হিসেবে ওর পরিবারের সাথে একজন নিঃস্বার্থ বন্ধু হিসেবে পাশে থাকবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। অমনি প্লেনের টিকিট কাটলেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।

ইমু হাসান কে ইনবক্সে জানিয়ে দিলেন, তিনি আসছেন।
ইমু সাহেব ভাবলেন শ্রাবণীকে কিছুই বলবেন না, সারপ্রাইজ দেবেন। যাতে শ্রাবণী তার প্রিয় পছন্দের মানুষকে দেখে অনেক খুশি হতে পারে। কিন্তু শ্রাবণীর শরীর ধীরে ধীরে খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। স্যালাইন চলাও বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। চোখ দুটো কোন মতে টেনে টেনে তাকাচ্ছে, বাধ্য হয়েই ইমু বলল-প্লিজ শ্রাবণী আর একটু ধৈর্য ধর, দেখ তোমার প্রিয় মানুষ টি কতদূর হতে ছুটে আসছে তোমাকে এক নজর দেখবে বলে।

শ্রাবণী: কার কথা বলছ গো! বুঝতে পারছি না তো।
ইমু: রবীউল হোসেন উনি আসছেন তোমাকে দেখার জন্য।
শ্রাবণী: কি বলছ, উনি কি করে খবর পেলেন, আমিতো কাউকে বলি নি।
ইমু : উনি নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলেছেন।
তোমার খবর নিয়েছেন আর উনি আজ বাংলাদেশে
আসছেন শুধু তোমার জন্যে।।

শ্রাবণীর শরীর খুব ক্লান্ত, বিছানার সাথে প্রায় লেপ্টে আছে, সাদা চাদরে পুরো দেহটা ঢাকা। শুধু টিক টিক করে দমের ঘড়িটা তখনো চলছে বলে মুখটা বের করা আছে। চোক দুটো বার বার দরজা ভেদ করে যতদূর দেখা যায় ততদূর দৃষ্টিমেলে আছে।
প্রিয় মুখটি দেখার আশায়। কিন্তু এই পৃথিবীতে সব আশা সব সময় পূরণ হয় না।
মনে মনে ভাবে শ্রাবণী —
জীবনের কিছু লেনা দেনা –
কভুও মিলে না,
অদেও থেকে যায় কিছু না
কিছু বাকি, এ যেন শুভঙ্করের ফাকি!!

আস্তে আস্তে শ্রাবণীর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। সাদা চাদরে ঢাকা পড়লো মুখটা। পরিবারের লোকজন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। রবীউল সাহেব যখন হসপিটালে এসে পোছালেন ততক্ষণে সব শেষ!! রবীউল সাহেব মৃত শ্রাবণীর পাশে এসে বসলেন। তার চোখ থেকে নিরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এ যেন অঝরে ঝরে যাচ্ছে শ্রাবণের ধারা।

রবীউল সাহেবের মনে সব সময় শত শত প্রশ্ন ঘোরে, তার মাঝে একটি জটিল প্রশ্ন হলো ভালোবাসা কারে কয়? শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যা হয়, নাকি বহু, বহুদূর বসে মন ছুঁয়ে ছঁয়ে যা হয় রবীউল সাহেব আজ অনুভব করতে পারছেন শ্রাবণীর ভালোবাসা কতোটা নিঃস্বার্থ ছিল। কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না তার নিখাদ ভালোবাসায়। শ্রাবণীর কথা ভেবে রবীউল সাহেবের চোখ থেকে অবিরাম শ্রাবণের ধারা ঝরে যেতে লাগলো।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com