প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। চেষ্টা করলে তারাও পারে স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে প্রতিবন্ধীরা গড়ে তুলেছেন গোয়ালন্দ উপজেলা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা। আর এ সংস্থায় প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা রয়েছে ৪৭৪ জন। একসময় প্রতিবন্ধীরা ঘাটে ভিক্ষা করলেও বর্তমানে নিজেদের প্রচেষ্টায় ফুল ঝাড়ু তৈরি করছেন। তাদের তৈরি এসব ফুল ঝাড়ু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাটে একসময় ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতো প্রতিবন্ধীরা। ভিক্ষা করেই জীবন চলতো তাদের। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই ঘাটের যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা কমেছে অনেক। ঘাটে আগের মতো যাত্রী না থাকায় তারা ভিক্ষা করেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিলো না। এরপর প্রতিবন্ধীরা নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি করছেন ফুল ঝাড়ু। আর এ ফুল ঝাড়ু তৈরি করে নিজের পায়ে দাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে তাদের নিজেদের হাতের তৈরি ফুল ঝাড়ু দিতে চায় দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভিন্ন উপজেলায়। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফুল ঝাড়ু তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায় জেলার দৌলতদিয়া ফেরীঘাট রোড শাহাদত মেম্বার পাড়া এলাকায় অবস্থিত গোয়ালন্দ উপজেলা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার অফিসে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে উপজেলার ৪ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গড়ে তোলে গোয়ালন্দ উপজেলা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা। বিভিন্ন সময়ে তারা স্থানীয়ভাবে ক্রীড়া অঙ্গনেও অংশ নিয়েছেন।
প্রতিবন্ধীরা জানান, ফুল ঝাড়ু তৈরির কাচামাল কক্সবাজার, বান্দারবান, খাগড়াছড়ি এসব জায়গা থেকে আনতে হয়। আমরা যারা প্রতিবন্ধী আছি তারাই সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাচামাল গুলো এনে থাকি। প্রতিবন্ধী ছাড়া এখানে আমরা কোন স্বাভাবিক মানুষদের নিয়োজিত করবো না। আমরা যারা প্রতিবন্ধী আছি তারাই এসব কাজ করবো। আর প্রতিবন্ধীদের দিয়ে বাজারজাতকরণ করা হবে। ফুল ঝাড়ু বেচা কেনায় ও মার্কিটিংয়ে প্রতিবন্ধীরাই তাদের কাজ তারাই করবে। এবং তারা সরকারের কাছে দাবি জানান, এ কাজের মধ্য দিয়ে সরকার যেনো তাদের পাশে থেকে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে পাশে থাকেন।
স্থানীয়রা জানায়, প্রতিবন্ধীরা এক সময় অন্যের হাতের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকতো। অনেকের কাছে হাত পাততো। অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। একাধিক মানুষের কাছে হাত পেতে তারা ভিক্ষা করতো। ঘাটের বিভিন্ন জায়গায় তারা ভিক্ষা করে চলতো। সমাজে তারা যেকোন কাজেই পিছিয়ে ছিলো। কিন্তুু এখন তারা কর্ম করে খাচ্ছে। কর্মের মাধ্যমে তাদের পরিবর্তন ঘটেছে। ফুল ঝাড়ু তৈরি করে প্রতিবন্ধীরা এখন জীবিকা নির্বাহ করছে। এটা আমাদের এলাকার সবাই এখন তাদের প্রশংসা করছে। এবং তাদের যেকোন প্রয়োজনে পাশে থাকার ও কথা জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসি।
সিদ্দিক সরদার নামের এক প্রতিবন্ধী বলেন, একসময় আমরা ভিক্ষা করতাম। এবং ভিক্ষা করেই সংসার চালাতাম। আমাদের ছেলে সন্তান আছে। ছেলে মেয়েরা আমাদের পেশা বলতে লজ্জা পেতো। আর এখন আমরা ভিক্ষা ছেড়ে ফুল ঝাড়ু তৈরি করছি। ছেলে মেয়েদেরও যেমন এ কর্ম দেখে ভালো লাগছে তেমনিভাবে আমাদেরও অনেক ভালো লাগছে যে আমরা ফুল ঝাড়ু তৈরির মাধ্যমে কর্ম করছি।
প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলাম বলেন, ফুল ঝাড়ু তৈরি করতে আমরা যে যেমন কাজ পারি তেমনিভাবে করার চেষ্টা করি। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি ফুল ঝাড়ু তৈরি করে আমাদের বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধী আছে যে যেরকম কাজ করতে পারে। তারা এ কাজ করে যাতে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে সেজন্যই আমরা এই ফুল ঝাড়ু তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি।
ইউনুস আলী খা নামের আরেক প্রতিবন্ধী বলেন, এখন আমাদের তৈরি ফুল ঝাড়ু গোয়ালন্দ উপজেলার চাদিহা মিটিয়ে অন্য অঞ্চলে পৌছানোর কাজ করছি। প্রতিবন্ধীদের হাতের তৈরি ফুল ঝাড়ুর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ চাহিদা এভাবে বাড়তে থাকলে আমরা দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা অঞ্চলে ফুল ঝাড়ু পৌছাতে পারবো। এবং আমরা আশা রাখছি ব্যাপকভাবে আমাদের তৈরি এসব ফুল ঝাড়ু বিক্রি হবে।
গোয়ালন্দ উপজেলা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মোন্নাব শেখ জানান, এই প্রতিবন্ধীরা যাতে বসে বসে এ কাজটা করতে পারে। এবং এদের কোন পরিশ্রম হয়না। এ কাজের মাধ্যমে হাটা চলার কোন প্রয়োজন নাই। আমাদের প্রতিবন্ধী সংস্থার কিছু সদস্য আছে তারা অটো রিকসা নিয়ে মার্কিটিং করছে। এবং এ ফুল ঝাড়ু গুলো বিক্রি করছে। প্রতিবন্ধীরা ভিক্ষা থেকে উঠে এসে এরা কর্মে নিয়োজিত হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্যই আমরা প্রতিবন্ধীদের কর্ম দেবো। আর এ স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়েছে। এবং ফুল ঝাড়ু তৈরির মাধ্যমে আমাদের কর্মের সুযোগ হয়েছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র জানান, আমরা এটাকে খুবই সাধুবাদ জানাচ্ছি এবং এই প্রতিবন্ধী যারা ঘরের বাইরে বেরোতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না, তারাও যেনো কিছু একটা করে খেতে পারে এবং প্রতিদিনই তাদের একটা আয় রোজগার থাকে এজন্য উপজেলা প্রশাসন থেকেও তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। এবং আমরা তাদের পাশে আছি। তারা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারে এজন্য যেকোন সহযোগিতা তাদের করা হবে।