রাজনীতি এক সময় ছিল জনতার সঙ্গে সরাসরি সংলাপের ক্ষেত্র। সভা-সমাবেশ আর পত্রিকায় মত প্রকাশ ছিল মতামত প্রচারের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু প্রযুক্তির প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানে সেই দৃশ্যপট আমূল বদলে গেছে। এখন একটি পোস্ট, একটি এডিট করা ভিডিও কিংবা সাজানো তথ্যই বদলে দিতে পারে জনমত, গড়ে তুলতে পারে বিভ্রান্তির দেয়াল। ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে রাজনৈতিক তথ্য প্রচারে যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা অসুবিধা। বাংলাদেশে অপপ্রচার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। সাংবাদিক, বিরোধী দল, এমনকি সাধারণ নাগরিকও এর শিকার। এই লেখায় আমরা খোঁজার চেষ্টা করবো, কারা চালায় এই অপপ্রচারের সংস্কৃতি এবং কেন চালায়।
ডিজিটাল অপপ্রচার বলতে বোঝায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা এবং গুজব ছড়ানো। বর্তমান বাংলাদেশে বেশিরভাগ নাগরিক ডিজিটাল মাধ্যমগুলোর সঙ্গে সর্বদা জড়িত থাকে। ফলে যেকোনো তথ্য তারা সেই মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে জেনে থাকে। এরই সুযোগ নিয়ে কিছু অপপ্রচার গোষ্ঠী মিথ্যা এবং গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ফলে বিভিন্ন নাগরিকের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ বিশ্বাস করে এবং একে অন্যের মাঝে তা ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই একটি মিথ্যা তথ্য সমাজের সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
এ কাজ মূলত করে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, যারা নিজেদের স্বার্থ আদায়ে এবং জনগণের মধ্যে বিরূপ মন্তব্য ঢুকিয়ে দেওয়ার কারসাজিতে লিপ্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে তাদের প্রচারণা বা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার অন্যতম কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে ডিজিটাল অপপ্রচারকে। মাঠের রাজনীতি যেমন দৃশ্যমান, তেমনি ভার্চুয়াল জগতে চলছে এক অদৃশ্য লড়াই, যেখানে তথ্য বিকৃতি, গুজব ছড়ানো এবং মিথ্যাচার এক সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে ডিজিটাল সেল বা সাইবার ইউনিট, যাদের মূল কাজই হলো অনলাইনে বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো, তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং ভিন্নমতকে দমন করা।
এই অপপ্রচারে ব্যবহৃত হয় হাজার হাজার ভুয়া ফেসবুক আইডি, কখনও বট অ্যাকাউন্ট, আবার কখনও পরিচিত মুখের ফেক প্রোফাইল। একই ধরনের বার্তা শত শত পেজ ও আইডি থেকে একযোগে ছড়িয়ে দিলে তা মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এডিট করা ছবি কিংবা ভুয়া ভিডিও প্রকাশ করে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি যারা সমাজে সচেতন বক্তব্য রাখে বা ভিন্নমত প্রকাশ করে, তারাও এই অপপ্রচারের শিকার হয়। ট্রলিং, গালাগাল, এমনকি মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত পায়।
এই ধরনের অপপ্রচারের ফলে সমাজে তৈরি হয় বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ। মানুষ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে না পেরে ভুল তথ্যে প্রভাবিত হয় এবং অনেক সময় তা থেকেই ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা বা সহিংসতা। গণতান্ত্রিক চর্চা যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত, সেখানে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। অনেকেই আর সাহস করে মত দেয় না, কারণ জানে অপপ্রচারের শিকার হতে হবে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো-এই অপপ্রচার যতটা না দলীয় স্বার্থ রক্ষা করে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে সামাজিক ঐক্যের। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ নাগরিকদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধে। আর এই সুযোগে কতিপয় রাজনৈতিক দল নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখে, কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও সচেতন কার্যক্রম, যেখানে নাগরিক, সরকার, গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকবে। সর্বপ্রথম দরকার ডিজিটাল সাক্ষরতার বিস্তার। নাগরিকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পদ্ধতি শেখাতে হবে। স্কুল-কলেজে মিডিয়া শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে-সব দেখা বা পড়া বিষয় বিশ্বাসযোগ্য নয়, তথ্য যাচাই করাও একটি দায়িত্ব।
একই সঙ্গে প্রয়োজন আইনগত কাঠামোর আধুনিকায়ন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন হয় স্বাধীন মত প্রকাশের অনুকূল, কিন্তু অপপ্রচার ও গুজব রোধে যথাযথভাবে কার্যকর। আইন প্রয়োগ যেন রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, হয় পক্ষপাতহীন এবং ন্যায়ভিত্তিক। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোরও রয়েছে বড় ভূমিকা-তারা যেন ভুয়া অ্যাকাউন্ট, বটচালিত প্রচার ও উসকানিমূলক পোস্টগুলো দ্রুত শনাক্ত করে এবং বন্ধ করতে পারে, সে প্রযুক্তি ও মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
এছাড়া, রাজনীতিতে দায়িত্বশীল আচরণের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দলগুলোর উচিত নিজেদের সমালোচনা সহ্য করার মনোভাব তৈরি করা এবং মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া। রাজনৈতিক বিরোধিতা যেন তথ্যভিত্তিক হয়, অপপ্রচারের ওপর নির্ভরশীল না হয়। মতের ভিন্নতা গণতন্ত্রের শক্তি-একে দমন নয়, বরং লালন করতে হবে।
সবশেষে, আমাদের প্রত্যেকের উচিত সচেতন নাগরিক হিসেবে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। গুজব না ছড়ানো, যাচাই না করা তথ্য শেয়ার না করা এবং যুক্তিবাদী আলোচনার পরিবেশ তৈরিই গড়ে তুলতে পারে একটি গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি।
লেখক পরিচিতি:-
রাখি আক্তার
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা
রাজবাড়।