মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ অপরাহ্ন

স্মরণীয় রয়ে যাবেন কর্মযজ্ঞের দীপের আলোয়

সৌমিত্র শীল চন্দন
  • Update Time : সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৮৮ Time View

শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি প্রয়াণে চলে যাওয়া এ জেলার প্রবীণতম সাংবাদিক রাজবাড়ী জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ সানাউল্লাহকে। তখনও আমি সাংবাদিকতায় প্রবেশ করিনি। তাঁকে দেখতাম কেতাদুরস্ত পোশাকে ছুটে বেড়াতে। রাজবাড়ী শহরে প্রবীণ সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম এটা জানতাম। সাংবাদিকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার পর প্রয়াত হিমাংশু কুমার সাহার মাধ্যমে সান্নিধ্যের সুযোগ মিলল মোহাম্মদ সানাউল্লাহর সাথে। হিমাংশু কুমার সাহা ও মোহাম্মদ সানাউল্লাহ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

জেনেছি, পাকিস্তানী আমল থেকে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। ৬৯ এর গণ অভ্যূত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার কর্মজীবনে বিভিন্ন সময়ে দৈনিক বাংলা, দৈনিক সমকাল, দৈনিক যুগান্তর, বিটিভি, বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কমসহ নানা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতা ছিল তার ধ্যান, জ্ঞান।

মোহাম্মদ সানাউল্লাহ প্রয়ানের আজ (২ এপ্রিল) ১৯ দিন পূর্ণ হলো। তিনি চলে গেছেন সে কোন দূর দেশে। একদিনও তিনি বিস্মৃত হননি আমার কাছে। তিনি আছেন স্মরণে-বরণে বিপুল কর্মযজ্ঞের দীপের আলোয়। ভীষণ কাজ পাগল মানুষ ছিলেন তিনি। সংবাদ পেলেই সব কিছু ভুলে যেতেন। তিনি আমাদের চেতনা হয়ে মিশে থাকবেন অন্তরে। নিঃসন্দেহে তাঁর মানবিক কর্মের দর্শন অনুপ্রাণিত করবে আমাদের।

নিউজের জন্য কত ঘুরেছি তার সাথে। যখন নিউজ থাকতো না তখন নিউজের খোঁজে বেরিয়ে পড়তাম অজানার উদ্দেশ্যে। এমন ঘটনা ঘটেছে তো কতবারই। খুব মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। পাংশার একটি ঘটনায় অজপাড়া গাঁয়ে ছুটে গিয়েছিলাম আমরা। গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তখন রাত্রি। অন্ধকার। বৃষ্টি নেমে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম, সানাউল্লাহ কাকু বুঝি যাবেন না। কিন্তু তিনি ছুটলেন আমাদের সাথে। সংবাদ পেলে এভাবেই তিনি ছুটতেন। বলতেন, আমার কাছে নিউজই সবকিছু।

সম্ভবতঃ রাজবাড়ীতে যারা সহকর্মী তাদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি তার সাথে। ক্ষমা সুন্দর পূর্বক কথাটি লিখতে চাই; বর্তমানে কপি পেস্টের যুগে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ উল্টো। নিউজ চার লাইনই হোক বা ৪০ লাইন। নিউজ যতই তৈরি করা থাকুক বা যার নিউজই হোক। তিনি কখনই সেসব নিউজ নিতেন না। টাইপ হয়তো করতে পারতেন না। কিন্তু নিজে কাগজে কলমে ড্রাফট করতেন। হাতে লিখতেন। যতক্ষণ তার মনপুতঃ না হবে ততক্ষণ তিনি সেটা কাটা ছেড়া করতেন।

বর্তমান সময়ে সাংবাদিকের একটা কার্ড পেলেই কারো অহংকার ক্ষমতা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। সেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কেউ কেউ। সানা কাকুকে দেখেছি সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে কখনও প্রভাব খাটাননি কোথাও। ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী আর মিষ্টভাষী। সাংবাদিক পেশার যে কেউ হোক না কেন তাদের কাছে নিয়ে গল্প করতেই পছন্দ করতেন তিনি। কখনও কখনও জমে উঠতো চায়ের আড্ডা। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রটি তিনি পরিচর্যা করেছেন সংস্কৃতিমনস্কতায়। সংবাদের অন্তরালে সামাজিক-সংস্কৃতির বিষয়টিও তিনি গভীর চিন্তায় লালন করেছেন। নিবেদিত মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। এ জেলার সাংবাদিক মহলে সে সমাদৃত শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে। এই অর্জন মোটেই সামান্য নয়।

সাংবাদিকের বাইরে তিনি নিরেট একজন ভালো মানুষ, মিষ্টভাষী। তার ঠোঁটের কোণে হাসি যেন সব সময় লেগেই থাকতো। কারো সাথে দেখা হলে হাসি দিয়ে কথা বলতেন। খুব কম দিনই গিয়েছে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। আর কোনো কারণে সাক্ষাৎ না হলে ফোন করতেন। খোঁজ নিতেন। আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে তাঁর কথাগুলো। সকাল বিকাল সন্ধ্যা কত সময় কেটেছে তাঁর সাথে।

হঠাৎই যেন নেমে এলো অমানিশা। একদিন শুনলাম, সানা কাকুর স্ত্রী আর নেই। এটুকু হয়তো সহ্য করার মত। সাথে সানা কাকুও স্ট্রোক করেছেন। তিনি হাঁটতে পারছেন না। এটা শোনার পর নিজেকে শান্ত রাখতে পারিনি। বড় মসজিদে সানা কাকুর সহধর্মিনীর জানাজায় তিনি গেছেন হুইল চেয়ারে করে। কী হৃদয় বিদারক দৃশ্য। কতবারই বলেছি, কাকু আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আবার আমরা নিউজ করতে বেরিয়ে পড়বো। কিন্তু তিনি ্আর সেরে ওঠেননি। দিন দিন তার অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে। সবই শুনতাম, জানতাম। ভয়ংকর কষ্ট লাগতো। কীভাবে গিয়ে দাঁড়াবো তাঁর সামনে? তাঁর মলিন মুখ সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুই করার নেই আমার? একারণে বরাবরই এড়িয়ে চলেছি। আজ ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সানা কাকুর কাছে। তিনি যেখানে আছেন সেখান থেকে যেন আমাকে ক্ষমা করেন।

মৃত্যুর ২০ দিন আগের কথা। আমি, রুমন ও সুমন রাজবাড়ী হাসপাতালে গিয়েছি কাকুর সাথে দেখা করতে। কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। যেন কত কিছু বলতে চাইছেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আর্শীবাদ করলেন।

কাকুর কাছে শুনেছি, রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনিসহ কয়েকজন। ক্লাবের ঘর করতে গিয়ে হামলার শিকারও হয়েছিলেন। তাদের হাতে গড়া সাংবাদিক সংগঠনটিতে থাকতে পারেননি। অনেক দুখ আর কষ্ট নিয়ে চেলে আসেন। প্রায়ই দুঃখ করতেন এসব কথা বলে। রাজবাড়ী জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার পরও তাকে সেই পদে রেখে সম্মান জানানো হয়েছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। যতদিন সুস্থ ছিলেন ততদিন সক্রিয়তার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মৃত্যু কর্মময় গতি স্তব্ধ করে দিলে তা শুধুই শোক নয়, ভারবাহী বেদনার বড় দিক। আমাদের কাছে এই কষ্টের বোঝা শূন্যতারও বেশি। তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, রাজবাড়ী জেলা প্রেসক্লাব ও জেলা প্রতিনিধি: দৈনিক সমকাল

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com