সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪২ অপরাহ্ন

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুর রাজ্জাকঃ একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ ও অনন্য সাংবাদিকতার প্রতিকৃতি

শাহ মুজতবা রশীদ আল কামাল
  • Update Time : বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২২
  • ১০১ Time View

আমার পরম শ্রদ্ধেয় চাচা ফকীর আব্দুর রাজ্জাক গত ২৫ শে অক্টোবর ২০২০ না ফেরার দেশে চলে গেছেন সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে। আমরা যারা এই পৃথিবীর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এর আলো-বাতাস, সৌন্দর্য-কদর্য, বিত্ত-বৈভব, নানা আকর্ষণের মাঝে সদা অবগাহন করছি তাদের পক্ষে সম্ভব নয় কোনো পরিচিত প্রিয়জনের মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নেয়া। তারপরও মেনে নিতে হয়। এটাই নিয়ম, এটাই বিধান।

ফকীর আবদুর রাজ্জাক রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির ভীমনগর তাঁর মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পদমদীর দক্ষিণবাড়ী গ্রামে স্বনামধন্য সূফি দরবেশ পরিবারে তিনি বড় হয়েছেন। তাঁর পিতা ফকীর আব্দুস সামাদ, চিশতীয়া তরিকার একজন পীরসাহেব ছিলেন। অল্পবয়সে তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর স্বনামধন্য দাদা ফকীর বাহাদুর আলী চিশতী নিজামীর স্নেহছায়ায় বড় হন এবং বড় ভাই ফকীর আবদুর রশীদ বাড়ীতেই অক্ষর শিখিয়ে ২য় শ্রেণীতে নবাববাড়ী প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা দেন পদমদী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বহরপুর জুনিয়র হাই স্কুল ও রামদিয়া বিএমবিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে। দাদর মৃত্যুর পর চাচা এবং বড় ভাই এঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিনি ১৯৬৩ সালে মাধ্যমিক ও রাজবাড়ী কলেজ হতে ১৯৬৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি বি.এ অনার্স ও ১৯৬৯ সালে এম.এ পাশ করেন।

ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতীর সাথে সক্রিয়ভাবে জরিয়ে পরেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনে সহপাঠাদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৬ দফা, ১১ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ইত্যাদি জাতীয় রাজনীতির ইস্যু ছাড়াও শিক্ষা জীবনের নানা আন্দোলনে জনাব ফকীর আবদুর রাজ্জাক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজশাহী শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও শাহ মখদুম হলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন।১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথানের প্রথম শহীদ ড. শাহসুজ্জোহার সেই নারকীয় হত্যাকান্ডের সময় তিনি জোহা সাহেবের সাথেই ছিলেন এবং তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিতে তিনি স্বাক্ষ্য দেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এর সময় বালিয়াকান্দি বোয়ালমারির একাংশ নিয়ে গঠিত আসনে নির্বাচনী কাজে যুক্ত হন।

১৯৭১ এর ২৬ মার্চ গোয়ালন্দ ও পরে রাজবাড়ীতে স্থানীয় প্রতিরোধ সংগ্রামে সম্পৃক্ত হন। এরপর গ্রামের বাড়ী দক্ষিণ বাড়িতে চলে আসেন এবং বহরপুর, রামদিয়া, সোনাপুরসহ বালিয়াকান্দির বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা এমনকি জঙ্গল ইউনিয়ন পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে দলবল নিয়ে ব্যপক পাহাড়ার ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশ ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে গোয়ালন্দ পার হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করলে তিনি কলকাতা চলে যান। বনগাঁর দুটি যুবক্যাম্পে মুজিব নগর বিপ্লবী সরকারের নিয়োগলাভ করে জনাব রাজ্জাক পলিটিক্যাল ইন্সাট্রাক্টর বা রাজনৈতিক প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনিও ভারতের দেরাদুন জেলার কালসী ও তান্ডুয়া জেলায় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মুজিব বাহিনীর লীডারশীপ ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং নিজের নেতৃত্বে একটি দল নিয়ে নভেম্বরে মাঝামাঝি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। কুষ্টিয়া এলাকা হয়ে যশোরের মধ্য দিয়ে নিজ জেলায় ফেরার পথে বেশ কয়েকটি রাজাকার ক্যাম্প ধ্বংস ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করে ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে গ্রামের বাড়ীতে পৌছেন এবং ১৫ ডিসেম্বর রাতেই রাজবাড়ী মহকুমা ছাড়াও মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে দলের সাথে রাজবাড়ী মুক্ত করার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ী মুক্ত হয়।

লেখাপড়া শেষ করে তিনি মানিকগঞ্জ মালুচি কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। ১৯৭২ এর ১৬ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগ নামে দেশে প্রথম যুব সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। শেখ মনির নেতৃত্বে প্রথম আহ্বায়ক কমিটির ১১ জনের মধ্যে জনাব ফকীর আবদুর রাজ্জাক একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালে সংগঠনটির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে তিনি প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাকশাল গঠন হলে তার অঙ্গ সংগঠন জাতীয় যুবলীগের কেন্দ্রিয় কমিটিরও তিনি সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর তিনি গোপনে দলকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, এরই ফল¯্রুতিতে ১৯৭৮ ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হলে তিনি যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জনাব আমির হোসেন আমুকে চেয়ারম্যান রেখে তাঁকে আরেক মেয়াদ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতার রিপোর্ট ও ফিচার লেখার কলাকৌশল রপ্ত করেন। সম্ভবত সেই আগ্রহ থেকেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলার বাণীতে সহকারী সম্পাদক হিসাবে শুরু হয় সক্রিয় পেশাদারী সাংবাদিকতা। তিনি বলেছেন, ‘‘সাহিত্য যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে সংবাদপত্রের লেখা সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি”। একবিংশ শতাব্দীর একালে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সংবাদপত্রের লেখাঝোকা যেমন সাহিত্যেরই ভিন্নধারা তেমনি ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মূল্যবান উপকরণ ও আইন আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গণ্য হচ্ছে।

কাজেই সংবাদপত্র কেবল প্রাত্যহিক খবর প্রকাশের মাধ্যম নয়, বিশ্বমানের উন্নত সাহিত্য রচনা ও প্রকাশের মাধ্যম। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এস বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে হয়তো আবার অধ্যাপক জীবনে ফিরে যেতে পারতেন অথবা অনেকের মত লোভনীয় পদে যোগদান করে বাকী জীবন আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। একদিকে সদ্য স্বাধীন মাতৃভূমির কল্যাণ চেতনা অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনির অমোঘ টানে ১৯৭২ এর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় যোগদান করেন। সেই থেকে সাংবাদিকতার কঠোর জীবন বেছে নেন ফকীর আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় তিনি কখনোই চিন্তায় চেতনায় রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। আওয়ামী যুবলীগের নেতা হিসাবে রাজনৈতিক জীবন অব্যাহত রাখেন।

অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় আত্মনিয়োগের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত সততা, যোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব সকল বিতর্কের উর্ধ্বে স্থান পেয়েছে। একজন সৎ, নির্লোভ ও সদালোপী মানুষ হিসেবে সুধীজনদের কাছে সুপরিচিত ছিলেন।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক ফকীর আব্দুর রাজ্জাক পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেন। তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব উৎসব, ৭৪ সালে পিয়ং ইয়ং এ বিশ্ব যুব উৎসব এবং ৯০ সালে ওয়াশিংটনে বিশ্ব মিডিয়া কনফারেন্সে যোগদান করেন। ফকীর আব্দুর রাজ্জাকের লেখার ভাষাবোধ অত্যন্ত শক্তিশালী। জীবনঘনিষ্ঠ সমাজের সমস্যা সংকটের কথা তাঁর ক্ষুরধার লেখায় তিনি তুলে ধরতেন। বিভিন্ন পত্রিকায় কলামিস্ট হিসাবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। এ সময় অসংখ্য প্রতিবেদন ও নিবন্ধ লিখে আলোচিত হন। বিশেষ করে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকন্ঠ, সকালের খবর, আমার দেশসহ আরও কয়েকটি পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তাঁর পেশাদারিত্বের শৈল্পিক নৈপুণ্য সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠতা একটি মডেল হিসেবে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকরা বিবেচনা করেছেন।

ফকীর আব্দুর রাজ্জাকের রচিত বইগুলো হচ্ছেঃ
১। শেখ ফজলুল হক মনিঃ অনন্য রাজনীতির প্রতিকৃতি। আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১০
২। সত্য অন্বেষায় অবিরত, স্বরাজ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১১
৩। নির্মোহ দৃষ্টিপাত, স্বরাজ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১১
৪। প্রিয় অপ্রিয়কথা, স্বরাজ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১১
৫। নির্বাচিত কলাম (১) স্বরাজ প্রকাশনী, জুন ২০১৩
৬। স্মরণের আবরণে, স্বরাজ প্রকাশনী, জুন ২০১৩
৭। প্রারম্ভ, স্বরাজ প্রকাশনী, এপ্রিল ২০১৪
৮। নির্বাচিত কলাম (২), স্বরাজ প্রকাশনী, এপ্রিল ২০১৪
৯। দেশ-সমাজ, রাজনীতি, শেখ মনির ভাবনা সম্পাদনা গ্রন্থ, সেপ্টেম্বর ২০১১
১০। রাজনীতির পথেপ্রান্তে (১) আগস্ট ২০১৬
১১। রাজনীতির পথেপ্রান্তে (২) আগস্ট ২০১৬
১২। দূরবীনে দূরদর্শী, শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদনা ফকীর আব্দুর রাজ্জাক আগামী প্রকাশনা ২০১১
১৩। সামছুদ্দিন মোল্লা, অনবদ্য রাজনৈতিক জীবন, আগামী প্রকাশনী

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। রাজনীতির মহাকাব্যে তিনি চিলেন বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এক কবি, যার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। তাঁকে নিয়ে লেখা বইটি নতুন প্রজন্মকে যেমন উজ্জীবিত করবে তেমনি রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস অনুসন্ধানীদের অনুপ্রাণিত করবে। দেশ সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে অসংখ্য কলাম, প্রতিবেদন ও নিবন্ধ লিখে দেশ বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। একজন প্রথিতযশা কৃতি সাংবাদিক হিসাবে তাঁর সারা দেশে সুনাম রয়েছে। একজন মানবিকক বোধ সম্পূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ হিসেবে সাংবাদিকতা ও রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেছেন। তাঁর লেখা যে কয়টি বই বেরিয়েছে তা রাজনৈতিক সচেতন মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি বই পড়া লেখা এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চায় রত ছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন মানিকগঞ্জের ঝিটকা শরীফের পীর সাহেব দেওয়ান মহিউদ্দিন আহম্মেদ চিশতী নিজামী।

ফকীর আবদুর রাজ্জাক বেঁচে থাকবেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দেশ মাতৃকার গর্ভে। একজন অনন্য দেশপ্রেমিক সাংবাদিকতার প্রতিকৃতি হিসাবে তিনি চির জাগরুক থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।

তথ্যসূত্রঃ
 প্রফেসর ড. ফকীর আবদুর রশীদ, সাবেক অধ্যক্ষ, রাজবাড়ী সরকারী কলেজ, সজ্জনকান্দা রাজবাড়ী।
 মোঃ নুরুল আলম খাঁন রচিত প্রবন্ধ প্রথিতযশা কৃতি সাংবাদিক ফকীর আব্দুর রাজ্জাক।
 বালিয়াকান্দি উপজেলা সমিতি, ঢাকা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com