সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪১ অপরাহ্ন

চরাঞ্চলে রাসেল ভাইপারসহ বিভিন্ন সাপের উপদ্রব ॥ আতঙ্কে এলাকাবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩
  • ১৩৯ Time View

‘আল্লাহ বাঁচাইছে তাই এহনও বাঁচে আছি। যে সাপ কামড়াইছে শুনলাম এই সাপ কামড়াইলে মানুষ বাঁচে না। সেদিন সহালে পাট ভূইতে যাই পাট নিড়েনের জন্নি। ঘাট কাটার সময় ডাইন হাতের বুড়ো নকের ওপরে কি যেন কামড় দেয়। কামড়ের পরে জ্বলে পুরে যাচ্ছিলো। তাকায়া দেহি এ্যটা সাপ। হাতের কাচি দিয়ে সাপ মারে ফেলি। তারপর গামছা দিয়ে হাতের ড্যানায় বাদে সাপ নিয়ে পাংশা হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতালের ডাক্তাররা সাপ দেহে কলো রাসেল সাপ খুব বিষাক্ত। হেনে আপনের চিকিৎসা হবে না। আপনি কুষ্টিয়া হাসপাতালে চলে যান। পরে সাপ নিয়েই কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চলে যাই। সেনে চারদিন ভর্তি থাহে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে আসি। ডাক্তাররা কয়ছে আর যাওয়া লাগবি না। এহুন আমি গায়ে আগের মতন বল পাই নে।’ এভাবেই কথা গুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদ প্রামাণিক।সরেজমিনে হাবাসপুর ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের পদ্মা পাড়ের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে জানা যায়, এই দুই ইউনিয়নের নদী পাড়ের কয়েকটি গ্রাম ও চরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বিষাক্ত সাপ রাসেল ভাইপারসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত সাপ। গত ৩ জুলাই হাবাসপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদ প্রামাণিকে কামড়ানোয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নদীর পাড়, জেলের জালে, আখ ক্ষেত, পাট ক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে প্রায়ই দেখা মিলছে বিভিন্ন ধরনের সাপ।সাপের ভয়ে দুই ইউনিয়নের অনেক কৃষক ক্ষেতে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। সাপের উপদ্রব কমাতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।

চরপাড়া গ্রামের কৃষক আজাদ বলেন, আমরা তো মাঝে মাঝেই সাপ দেখি, নদীতে দেহি, দোয়াড় পাতলি দেখি,পাট ক্ষেতে দেখি,কুশাড় ক্ষেতে দেখি। মাঝে মধ্যে মাড়েও ফেলি। আমরা তো জানিনে এইগুলো বিষাক্ত রাসেল ভাই ভাই সাপ। এহন আমরা তো খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। আর কয়দিন পর বন্যার পানি আসপিনি তহন তো আরও বেশি দেহা যাবি।

ওই গ্রামের আরেক কৃষক আইয়ুব আলী বলেন, মানে তিন চারদিন আগে কুশোড় খেতে কুশোর জড়াতি গিছলাম। কুশোড়ির জরের ভিতর ইয়া বড় এ্যটা সাপ দেখি। শিয়েলের চোহির মত চোক, ফলা ধরলি মনে করেন এ্যাটা মানুষ চলে যাবি ওর গলার ভিতর।ভয়ংকর সাপ দেহে কুশোড় জরানো ফেলা থুয়ে চলে আইছি। আর ওই মাঠেই যাই নাই।

আব্দুল গফ্ফার বলেন, আমাদের এলাকায় প্রচুর সাপ। কয়েকদিন আগে একটা দাঁড়াশ সাপ মারা হয়ছে, দশ হাত লম্বা হবে। আজও মাছ ধরা জালের ভিতর থেকে তিনটে সাপ মারা হয়েছে। আমরা ওই সাপ চিনে নে,নতুন সাপ। ওইদিন আমাদের একভাই জাহিদের সাপে কামুড় দিছে পরে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেছে। ওর নাকি রাসেল ভাইপার সাপ কামড়াইছিলো।

তিনি আরও বলেন, নদীর পাড়ে যাদের বাড়িঘর তারা তো বেশি বিপদে আছে। আর কয়দিন পরে নদী পানি যখন বাড়বো তহন তাদের ঘরের বিছানায় সাপ উঠে থাকবো। প্রশাসন যদি পদক্ষেপ নেয় তাহলি আমাদের জন্য ভালো হয়। আমাদের চরে প্রচুর সাপ।

নদীর পাড়ে দেখা হয় কৃষক রুস্তম আলীর সাথে তিনি বলেন, সাপের জন্নি পাট কাটপার পারি নে, সাপের জন্নি মাছ মারবার পারিনে। মাঝে সাজেই সাপ দেহা যায়। চরের ভিতর ঢোল কমড়ির বাগান আছে হনে সহালে যেয়া দেকবেন বিশাল বিশাল সাপ টান টানে হয়া শুয়ে আছে। মাঠে কাম করতে খুব ভয় লাগে আমাদের।

বাহাদুরপুর ইউনিয়নের কৃষক মন্টু মোল্লা বলেন, আরবছর দুড়ে বড় সাপ মারে মাটিতে গারে ফেলেছিলো লোকজন। পরে শুনলাম রাসেল সাপ না কি যেন বিষাক্ত সাপ। আমরা তো মাঝে মধ্যে সাপ দেখি কিছু সাপ চিনি যেমন গুক্কু সাপ, দারাজ সাপ, গুই সাপ, সুতোনলি সাপ। আরও মেলা সাপ আছে সেগুলো চিনি না। ভয়তো লাগেই মাঠে কাম করতে। কিন্তু কি করবো এম্মাই কাম করতে হবি। সাপ খেদানোর কোন যন্ত্রতো আমাদের কাছে নাই।

একই ইউনিয়নের তারাপুর গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, পদ্মার চরে বিভিন্ন সাপ দেখা যায়। কিছু কিছু সাপ চিনি যেগুলো মধ্যে কিছু সাপ বিষধর আবার কিছু সাপ বিষধর না। বছর খানেক আগে চরে কৃষকেরা আখ কাটতে গিয়ে দুটি সাপ পিটিয়ে মেরে ফেলে। সাপ দুটি লম্বায় ছিলো প্রায় চার ফুট। পরে ইউটিউব ও গুগলে সার্চ দিয়ে জানতে পারে সাপ দুটি রাসেল ভাইপার।

শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, গতকাল পদ্মার চরে বিশাল বড় একটি সাপ দেখে স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে মাইকিং করেছে। সবাই যেন সতর্ক থাকে। এবছর এখনো শুনতে পায়নি যে কাউকে সাপে কামড়েছে।

হাবাসপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আল মামুন খান বলেন, সম্প্রতি চরপাড়া গ্রামে এক কৃষকে সাপে কামড়ে ছিল। সে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে এখন সুস্থ। আমার এই ইউনিয়নের বড় একটা অংশ নদীর পাড়ে। এখন পর্যন্ত সাপের উপদ্রব বাড়ার খবর পাই নাই। বর্ষার সময় উপদ্রব বাড়ে কারণ পানির সাথে বিভিন্ন জায়গা থেকে সাপ ভেসে আসে। অন্য বছর সাপের উপদ্রব কম থাকলেও এবার হয়তো বাড়তে পারে। আমরা নদী পাড়ের মানুষদের বলেছি আপনারা সচেতন থাকবেন। কাউকে সাপে কামড়লে সে যেন সাথে সাথেই হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়। এছাড়া আমরা খুব অল্পদিনের মধ্যেই নদী পাড়ের এলাকা গুলোতে উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রচার করবো।

পাংশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন কুমার ঘোষ বলেন, হাবাসপুর এবং বাহাদুরপুর এলাকায় সাপের উপদ্রব বেড়েছে এটা আমরা শুনেছি। এবিষয়ে আমরা উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা একটি মিটিংও করেছি।

রতন কুমার ঘোষ আরও বলেন, আমরা কৃষকদের মাঝে সচেতনতা মূলক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছি। তারা যেন মাঠে কাজের সময় পাহাড়ার ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও সাপ তাড়াতে তারা কার্বলিক এসিড ব্যবহার করতে পারে।

পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাফর সাদিক বলেন, চরাঞ্চলে বিশেষ করে বর্ষায় সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। সম্প্রতি উপজেলার হাবাসপুর ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নে কয়েক ঘটনা জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে । এবিষয়ে আমরা ওই এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রচার করবো।

রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ইব্রাহিম টিটন বলেন,রাজবাড়ীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ সাপের বিষের প্রতিষেধক ছিল, তার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা নতুন প্রতিষেধক সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। যদি কেউ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় সে যেন হাসপাতালে চলে আসে। যদি বিষাক্ত সাপে কামড়দেয় তাহলে আমরা ওইসব রোগীকে ফরিদপুর অথবা কুষ্টিয়াতে পাঠিয়ে দিবো। আর এরমধ্যে সাপের বিষের প্রতিষেধক চলে আসলে জেলার হাসপাতাল গুলোতেই চিকিৎসা দিতে পারবো।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com