একথা সবাই জানে যে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু জাতির জনকের পক্ষে থেকে আরো এক নায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখে দেশ বিদেশে আমাদের মুখ উজ্জল করেছেন স্বাধীনতার অন্যতম সংগঠক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারী রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার পদ্মতীরের হরিনবাড়ীয়া গ্রামে (তৎকালীন ফরিদপুর জেলার, গোয়ালন্দ মহাকুমারের এলাচীপুর) মাতুলয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর শৈশবের দিনগুলোও কেটেছে বেলগাছি ও রতনদিয়া বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে। তার মাতুলয়ের স্বজনদের সাথে কথা বললে এখনো শোনা যায় আবু সাঈদ চৌধুরীর শৈশব কাহিনী। ১৯২০ সালে রতনদিয়া রজনীকান্ত বিদ্যালয়ের পাশে ছোট এক পাঠশালা গড়ে ওঠে। ১৯২৪ সালে এই পাঠশালায় বাল্যশিক্ষা পড়েন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তবে এখানে বেশিদিন থাকা হয়নি আবু সাঈদ চৌধুরীর। তাকে পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের নাগবাড়ী গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকে তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৪০ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্ট কলেজ থেকে স্বাতক ও ১৯৪৭ সালে লন্ডন থেকে ব্যারিষ্টারী পাশ করেন। আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্থানের এডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৬১ সালে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর ২ বছর পর তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
আবু সাঈদ ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান । একাত্তরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। জেনেভায় অবস্থানকালে ওই দেশের একটি সংবাদপত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রের হত্যার সংবাদ দেখে তিনি বিচলিত হন। ফলে তিনি ভাইস চ্যান্সেলর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি মুজিব নগর সরকারের পক্ষে কাজ শুরু করেন। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে জেনেভা থেকে তিনি লন্ডন যান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।এভাবে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলার মানুষকে তিনি উজ্জীবিত করেন। যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন। মূলত তিনি ছিলেন বহির্বিশ্বে বাঙালিদের ঐক্যের প্রতীক। ইউরোপ ও আমেরিকার বাঙালি সমাজকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মন্ত্রে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৭ আগস্ট লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করেন। তিনি যুক্তরাজ্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক গিয়ে সেসব দেশের সরকার, জনপ্রতিনিধি, বিচারক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দূতাবাস এবং সাইপ্রাস, যুগোশ্লাভিয়া ও আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক রেডক্রস, অ্যাসেসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট ও কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মতো আন্তর্জাতিক সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। ফলে পাকিস্থানীদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ শুরু হয়। একপর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আবু সাঈদ চৌধুরী স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। ১০ জানুয়ারি দেশে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শপথের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আলীঙ্গন করেন। আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ। বাঙালী জাতীর কাছের মানুষ। কালুখালীবাসীর কাছের মানুষ। সর্বপরি সে আমাদের কাছের মানুষ। স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীতে এই মানুষটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।