“মরণ সাগর পাড়ে তোমরা অমর
আঁধারের হৃদপিন্ড থেকে ছিনিয়ে এনেছো আলো,
তোমাদের প্রজ্জ্বলিত মশাল হাতে
স্বাধীনতার সূর্য এলো।”
প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর সব বুদ্ধিজীবীকে হত্য করে। পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় এ কাজে বাংলাদেশিদের মধ্যে রাজাকার, আল বদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের চূড়ান্ত পরাভব স্বীকারের আগমুহুর্তে বরেণ্য বুদ্ধিজীবিদের ঠান্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁদের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শবদেহগুলো বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়। তিনদিন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি, খুবলে খেয়েছে শকুন কিংবা কুকুর কিংবা ফেলে দেয়া হয়েছে কোন গর্তে যা আর কেউ কখনো খুঁজে পায়নি, কোনো সন্ধান মেলেনি।
শহীদ বুদ্ধিজীবিদের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও দেশ গঠনে তাঁদের অভাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারী গণবাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন “বর্বর হানাদার শত্রুরা আমাদের সামাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করার জঘন্য প্রচেষ্টায় মেতেছিল। যেসব মনীষীরা আমাদের সামাজের উন্নতির পথ নির্দেশনা করতে পারতেন সেইসব বুদ্ধিজীবি এবং দক্ষ জনশক্তিকে তাঁরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমরা অনেক অমূল্য প্রাণ হারিয়েছি।”
বাংলা মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা নিম্নরূপ শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবি ৪২ জন, অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রকৌশলী ১৬ জন। এসব সংখ্যার বিষয়ে মতান্তর হতে পারে। উল্লেখযোগ্য হলেন- ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ড. মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, হুমায়ুন কবির, ফজলুর রহমান খান, এন. এম মনিরুজ্জামান, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এম.এ সাদেক, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, রাশীদুল হাসান, গিয়াস উদ্দিন আহমদ সহ আরও অনেকে। চিকিৎসকদের মধ্যে অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান প্রমূখ। এছাড়াও সাংবাদিক, শিল্পীদের মধ্যে – সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দিন হোসেন, গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, লেখক ও দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা, লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, কবি মেহেরুন্নেসা সহ আরও অনেকে শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে ৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে।
বুদ্ধিজীবি নিধন পরিকল্পনা যারা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই ঘাতক আল বদর কখনো তাদের অপরাধ স্বীকার করেনি, কিন্তু আল বদর বাহিনী গঠনের সবিস্তার বিবরণী তারা দাখিল করেন তাদের প্রণীত গ্রন্থে। সেলিম মনসুর খালিদ প্রণীত উর্দুগ্রন্থ আল বদর প্রকাশিত হয়েছিল লাহোর থেকে জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে ১৯৮৫ সালে। এই বইয়ে আল বদর প্রধান, তাদের সহকারী ও অন্য সদস্যদের বিভিন্ন ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে ইসলামের স্বঘোষিত রক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তবে সবার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ছদ্ম নাম। তারপরও সবচেয়ে বড় যে স্বীকৃতি ফুটে উঠেছে তা হলো সেনাবাহিনীর বিধিবদ্ধ কাঠামোর বাইরে জঙ্গী ও হিং¯্রাশ্রয়ী ইসলামের অনুসারী রাজনৈতিক দলের তরুণ ক্যাডারদের সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও অর্থ দ্বারা সমর্থিত ও পরিচালিত গোষ্ঠীর রূপান্তর। এই গোষ্ঠী হবে ঘাতকগোষ্ঠী, মূল মন্ত্র¿ হবে ইসলামের শত্রুকে উৎখাত করা, সেটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বুদ্ধিজীবি হত্যায় আল বদর নেতা আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান ও কাদের মোল্লার ভূমিকা বারবার উঠে এসেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে।
৭১ এর গণহত্যার একটি ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি হচ্ছে তালিকা প্রস্তুত করে দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুদ্ধিজীবি ও পেশাজীবিদের হত্য করা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জামায়েত ইসলামীর দলীয় ঘাতক বাহিনী “আল বদর” এই বুদ্ধিজীবি হত্যা কার্যকর করেছিল। তারা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বির হৃদপিন্ড উপড়ে ফেলেছিল, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলিম চৌধুরীর চোখ উপড়ে ফেলেছিল, কবি সেলিনা পারভীনের হাতে আঙ্গুল ও স্তন কেটে ফেলেছিল। এই হত্যাকান্ডের জন্য ঘাতকরা বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এই পাশবিকতা হিটলারের নাৎসী বাহিনীর চেয়েও ভয়াবহ ছিল।
এই বদর বাহিনী শুধু ইসলামের শত্রুই নয় এরা হলো জালেম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭১ এর ঘাতকদের বিচার আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে ৭৫২ জন ঘাতক দালালের বিচার শুরু করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই যুদ্ধাপরাধী বিচারের পথকে রুদ্ধ করে দেন। রাজাকারদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বেগম খালেদা জিয়াও কুখ্যাত মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করে একাত্তরের ঘাতকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবিরা দেশকে ভালোবেসে দেশ স্বাধীন করার সংকল্পের বিশ্বাসে অনড় অবস্থানে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল তাঁদের আনাগোনা। ষাটের দশকের আন্দোলন ও যুদ্ধ চলাকালীন তারা এক হয়ে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য অদৃশ্য শক্তিশালী ঢাল সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁদের সবার ছিল অপার্থিব গুণাবলী, গান গাইতেন, গান বাঁধতেন, সুর তুলতেন, সংবাদ কুড়াতেন, চিকিৎসা করতেন, শিক্ষা বিলাতেন, নাটক লিখতেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন, রাজনীতি করতেন।
বীরের বেশে তাঁরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমির জন্য। অস্তাচলে চলে যাওয়া সেইসব অরুণের আলোতেই এখনও বাঙালির পথ চলা। কবি গুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার, ক্ষয় নাই।”
লেখক পরিচিতি
শাহ্ মুজতবা রশীদ আল কামাল
সহকারী অধ্যাপক
ডা. আবুল হোসেন কলেজ, রাজবাড়ী।