সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

সরকারি হাসপাতালের ‘দালাল’ সমাচার -ডা. রাজীব দে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ২২ Time View

সরকারি হাসপাতালের ‘দালাল’ সমাচার!
ডা. রাজীব দে সরকার

আচ্ছা, অনেক ভারী আলোচনা না করে আসুন একটা গল্প বলি।

ধরেন, একটা জেলা সদর হাসপাতালে গেলেন।

গেলেন হাসপাতালটার জরুরী বিভাগে। জরুরী বিভাগ হলো হাসপাতালের সবচেয়ে ডায়নামিক জায়গা। সব দিক থেকেই ডায়নামিক। যেমনঃ এখানে সব সময় রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। প্রচন্ড অসুস্থ রোগীরা সবার আগে এখানেই আসেন। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত রোগীরাও এখানে আসেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের জটিল রোগ নিয়েও অভিভাবকরা দুপুর রাতে এখানেই আসেন। আবার গ্রামের মানুষজন মারামারি করে একে অন্যের মাথা ফাঁটিয়ে মামলার মতলব নিয়ে সদলবলে এখানে আসেন। মানে জরুরী বিভাগ আসলে রোগী দিয়ে সব সময় ভরা থাকবে। একটি ছোট্ট জায়গায় অনেক রোগী এক সাথে এসে সবার প্রয়োজন এক সাথে তুলে ধরলে কি একটা অবস্থা তৈরী হতে পারে আশা করি বোঝা যাচ্ছে।

এবার বেচারা ডাক্তার সাহেবের জন্যও জরুরী বিভাগ সুপার ডায়নামিক জায়গা। সবাই এসে বলে তার রোগী ‘সিরিয়াস’। যে সাধারণ সর্দি কাশি নিয়ে এসেছে, সেও সিরিয়াস, আবার “২/৩ দিন ধরে পায়খানা ক্লিয়ার হচ্ছে না” সেই রোগীও বলে তার রোগ সিরিয়াস। আসলে “সিরিয়াস” অবস্থায় থাকেন ডাক্তার সাহেব নিজে। কারণ রুম ভর্তি এক গাদা অসহিষ্ণু রোগী ও রোগীর স্বজন রেখে তিনি দ্বিতীয় কোন কাজের আর ফুরসৎ পান না। যেমনঃ তিনি ওয়াশ রুমে যেতে পারেন না, প্রয়োজনের সময় নাস্তা করতে পারেন না, এমনকি তার পরিবার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোন ফোন এলে রিসিভও করতে পারেন না। একের পর এক রোগীকে তাদের কষ্ট থেকে উপশম দিয়ে চলাই তার কাজ।

তো ধরেন, আমাদের গল্পে, সেই জরুরী বিভাগে একজন ডাক্তার বসে রোগী দেখছেন। তাকে ঘিরে আছেন এক দল রোগী ও তার স্বজন। এর মধ্যে হঠাৎ একজন এসে বললেন, “স্যার আমার এই রোগীটা একটু সিরিয়াস, একটু দেখে দেন। লাগলে টেস্ট দিয়ে দেন। করায়ে নিয়ে আসি”। এই লাইনটা শোনা মাত্রই ডাক্তার সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। কারণ গরীব জনপদের রোগীর তো টেস্ট করার ব্যাপারে আগ্রহ থাকতে পারে না।

আসলে রোগীর এই চরম হিতাকাঙ্খী মানুষটি রোগীর কেউ নন। তিনি ডায়াগনস্টিক ল্যাবের এজেন্ট বা ফিল্ড ম্যানেজার বা প্রমোশনাল ম্যানেজার বা এক্সেকিউটিভ। যে আহামরি নামেই তাকে ডাকি না কেন, সাধারণের ভাষ্যে তিনি একজন ‘দালাল’!এই শব্দটি অ্যাপোস্ট্রপি বা কোটেশন মার্কের মধ্যে রাখলাম, কারন ‘দালাল’ শব্দটি আমার তৈরী করা না। সাধারণ মানুষ ডায়াগনস্টিক এজেন্টদের এই নামেই সম্বোধন করেন বলে আমি স্বিতীয় কোন শব্দ আর খুঁজে পেলাম না। আমি তাদের পেশাকে অসম্মান করছি না। কিন্তু আর কোন উপযুক্ত শব্দ আমার জানা নেই। আমি আমার এই অপারগতা মেনে নিচ্ছি।

এই ‘দালাল’ শ্রেণীর পেশাজীবীদের একটি সুপরিচিত অভিনয় হলো, রোগীর কষ্টে ‘উহু আহা’ করা। এই উহু আহা করে তারা রোগী বা তার স্বজনদের সিমপ্যাথি অর্জনের চেষ্টা করেন। সিমপ্যাথিটা পেয়ে গেলে এই রোগী তার হাতের পুতুল হয়ে যায়।

জরুরী বিভাগে এসে চিকিৎসককে দিয়ে অনেক গুলো টেস্ট লিখিয়ে নিয়ে প্রাইভেট ল্যাবের এবং কমিশনের মাধ্যমে নিজের পকেট ভারী করে ফেলেন এই মহাপুরুষেরা।

প্রশ্ন করতে পারেন, ডাক্তার সাহেব কেন ‘দালাল’ এর কথায় টেস্ট লিখে দিবেন?

কারণ খুবই সিম্পল। একজন চিকিৎসক মেধায়-জ্ঞানে-দক্ষতায় যতোই সমৃদ্ধ হন না কেন, আদতে তিনি একা, একজন নিরীহ সরকারী কর্মচারী। রাষ্ট্র তার রক্ষায় কোন নিরাপত্তা আবরণী দেয় নাই।

ধরেন, জরুরী বিভাগের চিকিৎসক সাহেব, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট লিখে দিলেন না। বিনিমিয়ে কি হবে? এই সুসংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট হাসপাতাল এলাকায় চিকিৎসককে নিয়ে কুৎসা রটানো শুরু করবে। চিকিৎসকের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। নারী চিকিৎসক হলে তার পোশাক ও চরিত্র নিয়েও টানাটানি শুরু হবে। চিকিৎসক জরুরী বিভাগের ভিতরে বসে নিরলসভাবে তার দায়িত্ব পালন করে হাঁপিয়ে উঠছেন, আর অন্যদিকে তার অজান্তেই হয়তো তার বিরুদ্ধে তৈরী হচ্ছে উত্তেজক পাবলিক সেন্টিমেন্ট।

“যস্মিন দেশে যদাচারঃ” যে দেশে যে নিয়ম আর কি! এই দেশে কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মটাই নিয়ম। সাধারণ জ্বরে ১ দিন ভোগা একজন রোগীর কোন টেস্টই আসলে প্রয়োজন নাই। তারপরও চিকিৎসক যদি টেস্ট লিখে না দেন, তিনি এই ‘দালাল’ দের মাধ্যমে পরিণত হবেন গণশত্রুতে। জ্বর যদি ৩-৫ দিনের বেশি হয়, একজন চিকিৎসক CBC, Dengue IgG+IgM, Urine RE,, কখনো বা এন্টিজেন টেস্ট সহ আরো কিছু টেস্ট লিখে দেন। কিন্তু এই সব টেস্টই তো সরকারী হাসপাতালে হয় এবং খুব সামান্য খরচে হয়। যেমনঃ Urine RE এই টেস্ট টা করতে সরকারী হাসপাতালে খরচ হয় ২০ টাকা। অথচ এই সকল টেস্ট ল্যাব প্রতিনিধিদের দৌরাত্নে রোগীরা অনেক বেশি টাকা খরচ করে বাইরের ল্যাব থেকে করে নিয়ে আসেন। চিকিৎসক সাহেব যদি ভুলেও ‘দালাল’ বাহাদুরের সামনে বলে ফেলেন যে হাসপাতালের ভিতর থেকে টেস্টগুলো করেন, তিনি আরেক দফা গণশত্রুতে পরিণত হবেন।

প্রশ্ন করতে পারেন, এদের বিরুদ্ধে কিছুই কি করার নাই? উত্তর হলোঃ ‘না’

কারণ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্র সেই ক্ষমতা কোন কালেই দেয় নাই, যে রোগীর স্বার্থে হাসপাতাল অথোরিটি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। মাঝে মাঝে জেলা বা উপজেলার প্রশাসনের বদান্যতায় ২/৪ জনকে আটক করা হয় অথবা বিশেষ অভিযানে হাতে নাতে ধরা গেলে কয়েকজন হয়তো ধরা পরে এবং সেগুলো নিউজে প্রচার হয় ঠিকই। কিন্তু এটি আসলে মহাসাগর থেকে ১ বালতি পানি তোলার মতোই। ভুলে গেলে চলবে না, লক্ষ কোটি টাকার বাণিজ্য জড়িয়ে রয়েছে এই সিস্টেমকে ঘিরে। এই সিস্টেমের ফলভোগী অনেকেই। চাইলেই কি সবার ফল গাছে হাত দেওয়া যায়!

বরং চিকিৎসক সাহেব নিরীহ মানুষ। সারাজীবন কারো ক্ষতি করেন নাই, ধান্দাবাজি শেখেন নাই। পড়াশোনা করেছেন। দিনের সিংহভাগ সময় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে পরে থেকেছেন। রাতের পর রাত জেগেছেন রোগীদের জন্য। নিজের মা-বাবা কে সময় না দিয়ে সময় দিয়েছেন অন্যের মা-বাবাকে।

নিরীহ মানুষরা অসম যুদ্ধে নামতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। অসম যুদ্ধ, সেটা যুদ্ধ নয়, সেটা অন্যায়, সেটা অত্যাচার। হাসপাতাল কেন্দ্রিক কতিপয় অসাধু লোক তাই চিকিৎসকদের পিছনে লেগে থাকেন। তক্কে তক্কে থাকেন কিভাবে হাসপাতালে এসে একটা হট্টগোল বাঁধানো যায়। বাণিজ্যের সাথে সেবার যুদ্ধে, আদিমকাল থেকেই বাণিজ্যই জিতেছে।

তবে গণমাধ্যমে যদি আরো সংবেদনশীল হতো, পরিস্থিতি এতো ভয়াবহ হতো না। কিন্তু কতিপয় গণমাধ্যম অনলাইনে কোন প্রকার যাচাই-বাছাই বা সরেজমিনে তদন্ত ছাড়াই যখন একজন চিকিৎসকের বিশেষায়িত সেবাকে “ভুল চিকিৎসা” বলে নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন, তখন এই সকল অসাধু সিন্ডিকেট আরো উৎসাহী হয়। আরো শক্তিশালী হয়। চিকিৎসকদের “গণশত্রু” বানাতে তাদের সুবিধা হয়।

যদি কখনো শোনেন হাসপাতাল এলাকার ফার্মেসীতে বা কোন ক্লিনিকের সস্তা আড্ডাখানায় সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিয়ে জমপেশ মুখরোচক আলোচনা হচ্ছে, ধরেই নিতে পারেন এই চিকিৎসকরা রোগীদের ভালোর জন্য কোন না কোন কাজ করছেন, যা এই বাণিজ্য সম্রাটদের স্বার্থে আঘাত হেনেছে।

যে চিকিৎসক টেস্ট লিখেন না বা কম টেস্ট লিখবেন, তিনি কেনই বা এদের চোখে ভালো হবেন? যে চিকিৎসক মুখের উপর প্রশ্ন করে বসেন “ভাই সাথের রোগী আপনার কে হয়?” সেই চিকিৎসক তো অবশ্যই খারাপ। যে চিকিৎসক বিনা প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক লিখলেন না, তার মতো খারাপ চিকিৎসক অত্র জেলায় আর একটিও নাই!!

তবে জেনে রাখুন, হাসপাতালে চিকিৎসক একা। বড্ড একা। তার সম্বল শুধু তার নলেজ আর স্কিল। এই নলেজ আর স্কিল অর্জন করতে তা বহু বিনিদ্র রজনী খরচ হয়েছে। এই নলেজ আর স্কিল তিনি অর্জন করেছেন আপনাদেরই জন্য। এই নলেজ আর স্কিল দিয়েই তিনি অজস্র রোগীকে সুস্থতার হাসি দিয়েছেন। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন আপনারই কোন স্বজনকে।

কিন্তু চিকিৎসকের আর কোন সম্বল নাই। আর কোন অস্ত্র নাই। সে একা এবং অসহায়। একজন চিকিৎসকের মূল শক্তি তার রোগীরা। রোগীরা যদি দালালদের হাতে জিম্মী হয়ে পরেন, একই সাথে চিকিৎসকও জিম্মী হয়ে পরেন অসত্য প্রোপাগান্ডার কাছে।

সরকারী হাসপাতাল গুলোতে অনেক সমস্যা আছে, এটা সত্য কথা। কিন্তু এর দায় চিকিৎসকের না। তিনি এই অবস্থা তৈরী করেন নি। বরং তিনিই সেই সৈনিক যিনি শত সীমাবদ্ধতার মাঝে থেকেও লড়াই করে চলেছেন। জরুরী বিভাগে তার বিশ্রাম নেই, তার আহারের সময় নাই, এক গ্লাস পানি খাওয়ার সময় নাই, প্রিয়জনের সাথে ১ মিনিট কথা বলার অবকাশ নাই, তিনি শুধু আপনার জন্যই সেখানে আছেন। তাই একজন চিকিৎসক আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তাকে সময় দিন, ধৈর্য্য ধরে তাকে সহযোগিতা করুন। তিনি আপনার জন্য নিজের সর্বোচ্চটা করবেন। কারণ তিনি আর কিচ্ছু শিখেন নি। শুধু এই একটা কাজই শিখেছেন। আপনার বা আপনার প্রিয় মানুষটার সেবা করার দুর্লভ ও মহিমান্বিত এই কাজ।

হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের থেকে বেশি “আপন” আপনার আর কেউ নাই।

ডাঃ রাজীব দে সরকার
সার্জারী বিশেষজ্ঞ, শিশু রোগ চিকিৎসক ও সার্জন

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com