আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু:
১৯৬৫ সালে আমার রাজনৈতিক গুরু কাজী হেদায়েত হোসেন সাহেবের কাছে আমরা ২৫/৩০ জন ছেলে একসাথে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করি। তারপর থেকেই দলকে মজবুত ও শক্তিশালী করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের নরঘাতকের বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল করি। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য আওয়ামীগের ৬ দফা, ছাত্র লীগের ১১দফা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হলো। ১৯৬৮-১৯৬৯ এর রাজ পথ থেকে আন্দোলন করেছি ১৯৭০-এ নির্বাচন করেছি। তারপর এলো ১৯৭১ এর উত্তাল মার্চ মাস। আমরা সবাই শুনলাম রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন। আমাদের প্রিয় নেতা ভাষণ দিবেন শুনে আনন্দে সবাই ব্যস্ত ছিলাম। বিকালের দিকে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন ।
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
আমি যদি হুমুক দিবার না পারি
তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল
যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে
শত্রুর মোকাবেলা করো।
তারপর থেকেই শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। তখন থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। আমাদের নেতা কাজী হেদায়েত হোসেনকে যেভাবেই দেখেছি তাতে আমি মনে করি সে একজন রাজবাড়ীর মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ছিলেন । তার সমস্ত দিক নির্দেশনা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ৮ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত কাজী হেদায়েত হোসেন সাহেবের নেতৃত্বে রাজবাড়ীর শহর ও গ্রাম গঞ্জে কমিটি করে আমাদের সমস্ত কাজ করতে হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পাক হানাদার বাহীনি ঢাকায় ভোর রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত হামলা করে অগণিত পুলিশকে হত্যা করে। তখন আমি আমার দলবল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। আমি ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর সাহেবের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি ।
উল্লেখ থাকে যে, আমার একটা হাত না থাকা অবস্থায় আমি ঘরে বসে থাকি নাই। দেশে তখন টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে হানাদার বাহিনী রাজবাড়ী উঠে আসে এবং ত্রাস সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় বিহারী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস সবাই হানাদার বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি করে। তখন আমরা এলোমেলো হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
আমার জন্মভিটা বরাট ইউনিয়নের পশ্চিম ভবদিয়া হাজী বাড়ী এবং আমি আমার ইউনিয়নের ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। এরপর সেখান থেকে এলাকাবাসীকে নিয়ে কোন রকম অঘটন যাতে না ঘটে আমি সেই চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমার এলাকা বাগদিপাড়ায় কুখ্যাত রিফুজি রাজাকার জানি ও তার দুই ভাই এলাকায় লুটপাট শুরু করে দিলো এবং রাজবাড়ী থেকে বিহারী এনে ৭-৮ জন পাল (মৃতশিল্প) ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করল এবং লুটপাট করে সবকিছু নিয়ে যায়। এ অবস্থায় আমি এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ১দিন পর আনুমানিক রাত ১২টার পর ঐ রাজাকারের বাড়ী ঘেরাও করি এবং এক এক করে ৩জনকে ধরে এনে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হত্যা করি এবং জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করি। পরে বুঝতে পারি এদেশে আমার আর থাকা চলবে না। মা-মাটি মানুষকে শত্রুমুক্ত করতে হবে এই চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে দলবল নিয়ে ভারতের দিকে ছুটে চলি । কোথায় ভারত, কোথায় ক্যাম্প জানি না তবুও যেতে হবে । আমার গ্রাম লালগোলা পদ্মা নদীর তীর থেকে আমরা একটা নৌকায় উঠে পরি। আমার সাথে ছিলেন আমার বড় ভাই বাবু মিয়া, এম এম দারোগ আলী, মোহন মাষ্টার, সুনিল, আবুল, সাত্তার সহ আরো ১৬ জন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। মাঝিকে আমি পশ্চিম দিকে নৌকা চলাতে বললাম। যেতে যেতে সূর্য্যনগর পৗছানোর পর মধ্যনদীতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল । ঠিক সেই সময় নৌকায় থাকা ১৬ জনের মধ্যে ২জন চিৎকার করে বলে উঠলো, ইরে মা আমরা আর মুক্তিযুদ্ধে যাবো না। সে ২জন নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নদীতে ঝাপ দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে গেলো। আমি নিষেধ করার পরও তারা আর ফিরলো না। তারা এখনও বেঁচে আছে। এটা দুঃখ জনক হলেও সত্যি ঘটনা। তারপর বাকি ১৪ জন নিয়ে আমরা পাংশা থেকে স্বরণার্থীদের সাথে মিশে ৮/৯ দিন ধরে হাটতে হাটতে ভারতে চলে যাই। আমাদেরকে যেতে হয়েছিল “খুব শিবির নিয়ন্ত্রণ পরিষদ কল্যাণী ক্যাম্প মুজিব নগরে”। আমার রাজনৈতিক গুরু কাজী হেদায়েত হোসেন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।
আমরা তার কাছে সমস্ত কথা খুলে বললাম। এবং আমি সুইসাইড স্কোয়ার্ডে নাম দেওয়ার কথা তুলে ধরলাম। তিনি বললেন সুইসাইড স্কোয়ার্ড সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা বা জ্ঞান নেই। তখন উনি আমাকে ক্যাম্পে থাকার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন যখন আমি বলি তখন যাবে। সেই থেকে আমি ক্যাম্পে বিভিন্ন কাজ করা শুরু করি,বাজার করা, রান্না করা, ষ্টোর পাহাড়া দেওয়াসহ ক্যাম্পে হাজার হাজার ছেলেরা থাকতো তাদের সাথে কথা বলে আলাপ আলোচনা করে কোন রকম খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হলে ক্যাম্পের নেতাদের সাথে বসে সেটা ঠিক করতাম। ভারতের কল্যানী ক্যাম্পে আমি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থেকেছি এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে এক সঙ্গে ক্যাম্পে থাকা সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্ব দরবারে চির স্মরনীয় হয়ে থাকবে। চীর স্মরনীয় হয়ে থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের নাম। জীবনের শেষ সময় তাই আগামীর প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান থাকবে তোমরা সবাই দেশকে ভালবাসবে দেশমাকৃতার তরে নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে ।