মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৯ পূর্বাহ্ন

আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা -কুইন

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪
  • ১১৪ Time View

আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা
কুইন
নীল নীল আকাশের
কাছে আজ যাওয়া চাই,
স্বপ্নের রঙে আজ
মনে রঙ মাখা চাই
সাড়া দাও” – কবীর সুমন

না পড়েও যে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়, তাও আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, লোক প্রশাসন, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পেয়ে, তা হয়ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলে জানাই হতো না।

জীবনের একমাত্র পরীক্ষা, যেটাতে আমার অংশগ্রহণ করা নিয়ে পরিবারের সকলের বিরোধিতা ছিল, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। এ বছর ৯ ফেব্রুয়ারি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফল প্রকাশিত হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় এবং সকলের দোয়ায় আমার চান্স হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুরে। আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল, ঢাবিতে বসে একটা পরীক্ষা দেওয়ার। এছাড়াও, আমার মা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। মায়ের মুখে ঢাবির কথা এত শুনেছি, আলাদা এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করত ঢাবির প্রতি। এই ঢাবিকে ঘিরে আমাদের কত ইতিহাস! সবসময় বিস্ময় জাগত মনে। ভেবেছিলাম ঢাবিতে বসে পরীক্ষা দেওয়া আর হয়ে উঠবে না।

আমার জমজ বোন এরিন এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছে। ও কিছুদিনের জন্য এসেছিল দেশে। ওর ফিরে যাবার ফ্লাইটের তারিখ পড়ল ২০ ফেব্রুয়ারি রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর। মায়ের কাছে আগেই আবদার করা ছিল আমাকে এবার বইমেলায় নিয়ে যেতেই হবে। সেই ডিসেম্বরে একুশের জামা কিনে রেখেছি। কত্ত নতুন বইও তো কিনতে হবে। না গেলে হবে কী করে!

যেই কথা সেই কাজ। ঘটনাচক্রে ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি ইউনিট তথা কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা। ভাবলাম, যদি সময় সুযোগ হয় এবং মা রাজি হন, তাহলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আসব। তাই বাসা থেকে এইচএসসি এর প্রবেশপত্র এবং ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র প্রিন্ট করে নিয়ে গেলাম। অন্তত ঢাবিতে বসে একটা পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছেটা আমার পূরণ হবে। তা আর হলো কোথায়। ২১ তারিখ ওয়েবসাইটে সিট প্ল্যান দেখার পর মনটা গেল খারাপ হয়ে। আমার সিট পড়ল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজে। মনটাই গেল ভেঙ্গে। মাকে বলার পর মা এক বাক্যে না করে দিলেন। তার সাথে যোগ হলো পরিবারের অন্য সকলের বিরোধিতা। নানি ফোন করে বকা শুরু করলেন। ছোট মামা ফোনে বললেন পরীক্ষায় একেবারেই না বসতে। তাদের সবার ধারণা ছিল কোনোভাবে যদি আমার চান্স হয়ে যায় ঢাবিতে, তাহলে আমি আর কিছুতেই মেডিকেলে পড়তে চাইব না। বড় মামাও মানা করলেন। আমার পরীক্ষায় বসা নিয়ে সম্মতি ছিল একমাত্র আমার বড় মামির। মামিই মাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, হেসে-খেলে একটা পরীক্ষা দেওয়াই যায়। জীবনে আর কখনও এত নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিতে পারব কি না কে জানে।

শেষমেষ মা রাজি হলেন পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে। একটা শর্তে। আমি যদি চান্স না পাই, তাহলে মন খারাপ করা যাবে না। আমি তো হেসেই কুটি কুটি। চান্স পেতে হলে কিছু পড়তে তো হবে। আমি তো কিছুই পড়িনি। চান্স পাওয়া তো আর মামাবাড়ির আবদার না। সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুতি নিয়ে গেলাম হলে। গিয়ে দেখি কলেজের অনেক বান্ধবীরই ওখানে সিট পড়েছে। আমার জীবনে এত ঠান্ডা মেজাজে আর কখনও পরীক্ষা দিয়েছি কি না কে জানে। একটা উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলতে পারি, হলে শিক্ষক ঢোকার একদম আগ পর্যন্ত আমি আর লিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাসগুলো মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে গল্প করেছি আর আমাদের দুঃসাহস নিয়ে নিজেরাই পুরো দমে প্রহসন করেছি। বাংলা ও ইংরেজিতে আমি বরাবরই ভালো। বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় ২০২২ ও ২০২৩ সালে ‘ভাষা ও সাহিত্য (বাংলা ও ইংরেজি)’ ক্যাটাগরিতে কলেজ গ্রুপে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী হওয়ায় বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে অন্যরকমের একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। আর ঢাবির বি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাতেও থাকে শুধু বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান। সাধারণ জ্ঞান নিয়ে একটু ভয় হচ্ছিল। তবে বাংলা ও ইংরেজির কারণে মনে একটা জোর পেলাম। নম্বর বণ্টন এবং বিগত পাঁচ বছরে আসা প্রশ্ন সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নিয়ে সাহস করে পরীক্ষায় বসলাম। প্রশ্ন ভীষণ সহজ মনে হচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল একটু পড়লেই একেবারে টপ করতে পারতাম হয়তো। তারপরও মাথা ঠান্ডা করে হাসিমুখে পরীক্ষা দিলাম। বাংলা, ইংরেজি নিয়ে তেমন একটা সমস্যা হয়নি। সমস্যা হলো সাধারণ জ্ঞান নিয়ে। তবে এই অংশে বাংলাদেশ বিষয়াবলি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি উভয়ই থাকে। মেডিকেল পরীক্ষার সাধারণ জ্ঞান অংশের জন্য বাংলাদেশ বিষয়াবলি পড়া ছিল। তাই বেঁচে গেলাম। আর কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল বলে দাগিয়ে ফেললাম। ঝুঁকি নিয়ে আর খুব বেশি দাগাতে গেলাম না। নেগেটিভ মার্কিং আছে তো আবার।

পরীক্ষা শেষে মাকে বলেছিলাম, মা, না পড়েও সেরা একটা পরীক্ষা দিয়েছি। আমার চান্স হবে না জানি, আবার হয়েও যেতে পারে। একটু দোয়া করো তো। মা তো শুনে হেসেই মরেন। আমিও নির্লজ্জের মতো হাসতে হাসতে সেদিন মায়ের সাথে শিল্পকলা ঘুরে মামাবাড়ি ফিরলাম। এরপর আর কী। পরের দিন আবার মেডিকেলে ভর্তির তারিখ থাকায় রাতেই ফিরে এলাম রাজবাড়ী। অনলাইন থেকে কৌতূহলবশত একটু একটু উত্তর মিলিয়েছিলাম। অনেকগুলো উত্তর সঠিক হয়েছিল জেনে ভালোই লাগছিল। তবে কোনোরকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখিনি।

আজ মা বাইরে থেকে এসেই দুপুরে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দেখলাম ফলাফল বেরিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ফলাফল দেখতে ওয়েবসাইটে ঢুকবই না। তারপরও কেন যেন মনে হলো একটু দেখিই না কী হয়। কী-ই বা আসে যায়। এরপর শুরু হলো ওয়েবসাইটে ঢোকা নিয়ে আরেক যুদ্ধ। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ওইটুকু একখানা ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করলে ও বেচারা আর আস্ত থাকবে কী করে? এটা অনেকটা ওই বিদেশ থেকে ফেরার সময় জোর করে লাগেজ আটকানোর মতো ব্যাপার। জায়গায় হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু জিনিসপত্র আটতেই হবে। ঠিক সেভাবেই ওয়েবসাইটের ধারণক্ষমতা না থাকলে কার কী এসে যায়। ফলাফল তো আমাদের দেখতেই হবে। বেশ কষ্ট করে ফলাফলের পাতায় ঢোকার পর যা দেখলাম, তা দেখার পর কেউ যদি আমায় চিমটি কেটে বলত এটা আমার ভ্রম ছিল, তাহলেও অবিশ্বাস করতাম না। শুয়ে শুয়ে ফলাফল দেখার পর আমি ওই অবস্থাতেই আহ্লাদ করে হাসতে লাগলাম জোরে জোরে। মা ঘুম ঘুম গলায় জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে। আমি আহ্লাদি গলায় বলে উঠলাম, মা, আমার চান্স হয়ে গেছে। মা কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। অতঃপর… ইতিহাস। লাফাতে লাফাতে গেলাম নানির কাছে। ফলাফল বলতে গিয়ে ফের খেলাম নানির কাছে এক গাল ঝাড়ি। জানতাম নানি বকবেন। মূলত ওই বকাটা শুনতেই যাওয়া আর কি।

মজার ব্যাপার হলো, আমি যে নম্বর পাব বলে ভেবেছিলাম, কাটায় কাটায় ঠিক সেই নম্বরই পেয়েছি। মা বললেন, খাতা নিশ্চয়ই খুব ভালো করে দেখা হয়েছে। লিখিত অংশ খুব ভালো হয়েছিল। ভালো হবে জানতাম। তবে মনে হয়েছিল অল্পের জন্য হয়তো চান্স হবে না। তাও যে আমি ৩৩৭তম হব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে, এ ছিল আমার কল্পনারও বাইরে।

তবে দারুণ একটা শিক্ষা হয়েছে আমার। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পর আমি আবারও নতুন করে শিখলাম, প্রতিটা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি আসলে আমাদের শুরু হয়ে যায় শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই। মাত্র কয়েক মাস ভর্তি কোচিং করেই যদি চান্স পাওয়া যেত, তাহলে প্রত্যেকেরই চান্স হতো। আমি শুধু মেডিকেলের জন্য কোচিং করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোচিং তো দূরের কথা, বিশেষ কোনো বইও কেনা হয়নি। তবে আমার সম্পদ যা ছিল তা হলো, পূর্ব অর্জিত জ্ঞান, সাহস আর আত্মবিশ্বাস। আমার কাছে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে মেধা অন্বেষণের জন্য প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছি, কী কী বই পড়েছি, আমি তখন একটু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাই। কারণ আমি বোঝাতে পারি না আমি আলাদা করে কোনো প্রস্তুতিই নিইনি। আজীবন শুধু ভালোবেসেছি সাহিত্যকে, পড়েছি আনন্দের সাথে আর জানার আগ্রহ নিয়ে।

সকলের ফলাফল ভীষণ ভালো হোক। সকলেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌঁছে যাক এই শুভকামনা রইল।

কুইন
৩৩৭তম (বিজ্ঞান)
কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৬:১৪ মি. (সন্ধ্যা)
২৮ মার্চ, ২০২৪

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com