রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুরে ৯৪ শতাংশ জমি নিয়ে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কাছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ হয়েছে। আব্দুল হাকিম মন্ডল দাবি করেছেন, জেলা পরিষদের জমি অবৈধভাবে দখল করে সেটি বিক্রি করেছেন স্বপন কুন্ডু। আর স্বপন কুন্ডু বলছেন, জমিটি তারা পূর্ব পুরুষের আমল থেকে একশ বছর ধরে ভোগদখল করছেন। তাকে অযথা হয়রানী করছেন আব্দুল হাকিম। আব্দুল হাকিম এবং স্বপন কুন্ডু দুজনই বহরপুর গ্রামের বাসিন্দা। বালিয়াকান্দি সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উভয়ই জানিয়েছেন, ওই জমির আশেপাশে জেলা পরিষদের জমি নেই।
যে জমিটি নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ হয়েছে সেটির অবস্থার রাজবাড়ী-বালিয়াকান্দি সড়কের পাশে। সেখান থেকে প্রায় দুইশ গজ দূরে বহরপুর রেলগেটে রয়েছে জেলা পরিষদের জমি। স্থানীয়রা জানিয়েছন, দীর্ঘ প্রায় একশ বছর ধরে স্বপন কুন্ডু ও তার পূর্ব পুরুষ ওই জমি ভোগদখল করে আসছেন। জেলা পরিষদ কখনও জমিটি তাদের বলে দাবি করেনি।
জানা গেছে, স্বপন কুন্ডু ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ৯৪ শতাংশ জমি বিক্রি করেন একই ইউনিয়নের নতুনচর গ্রামের বাসিন্দা তৈয়বুর রহমানের কাছে। জমিটি তৈয়বুর রহমানের নামে নামজারীও হয়। গত ৫ জুন মো. আব্দুল হাকিম মন্ডল রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক বরাবর দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ৯৪ শতাংশ সরকারি কৃষিজমি অবৈধভাবে দখল করে সেখানে মাটি ভরাট ও ফিলিং স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। জমিটি জেলা পরিষদের। অথচ স্বপন কুন্ডু তার নামে নামজারীর পর অবৈধভাবে বিক্রি করেছেন। এমন অভিযোগের পর জেলা পরিষদের সার্ভেয়ার শাহ ইমরান গত ১০ জুন তারিখে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর একটি প্রতিবেদন দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, হাকিম মন্ডলের অভিযোগের পর তিনি বহরপুর মৌজার আরএস ১৬১৫, এসএ ০৩ খতিয়ানভুক্ত ৪০৯৫ নম্বর দাগের ৯৪ শতাংশ জমি পরিদর্শন করেছেন। সেখানে মো. তৈয়বুর রহমান জমিটি ট্রাক দিয়ে মাটি ফেলছিলেন। অফিস নথি পর্যালোচনা করে দেখতে পান, আরএস ও এসএ রেকর্ডে জেলা পরিষদের নামের ৪০৯৫ নম্বর দাগটি বিএস জরিপে ১৭৯৮ নম্বর খতিয়ানভুক্ত স্বপন কুমার কুন্ডুর নামে রেকর্ডভুক্ত হয়। ওই রেকর্ডের আলোকে স্বপন কুমার তৈয়বুর রহমানদের কাছে জমিটি বিক্রি করেন। পরে বালিয়াকান্দির এসি ল্যান্ড মো. হাসিবুল হাসান তৈয়বুর রহমানদের নামে নামজারি করেন।
গত ২৩ জুলাই তারিখে জেলা পরিষদের সার্ভেয়ার শাহ ইমরানের কাছে মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, জমিটি মাপামাপি হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। এসি ল্যান্ড নিজেও ছিলেন মাপামাপির সময়। জেলা পরিষদের জমি মেপে ছয় শতাংশ কম পাওয়া গেছে। সেটি যে কোন দাগের সেটা বের করার জন্য কাগজপত্র তুলতে দেওয়া হয়েছে। স্বপন কুন্ডুর জমির মধ্যে জেলা পরিষদের কোনো জমি আছে কীনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, সেখানে জেলা পরিষদের কোনো জমি নেই বা দাবি করার সুযোগ নেই।
অভিযোগকারী আব্দুল হাকিম মন্ডল জানান, ওই জমির পাশে তার গার্ডেন অর্গানিকস রয়েছে। এটি গবেষণা, সংরক্ষণ ও উদ্ভাবনে দেশ সেরার পুরস্কার লাভ করেছে। তার এই গার্ডেন অর্গানিকসটি কোনভাবে দূষণ হলেই সমস্যা। কিন্তু স্বপন কুন্ডু ওই জমি একজনের কাছে বিক্রি করেছেন। সেখানে ভরাট করে পেট্রোল পাম্প করা হবে বলে শুনেছেন। যেটি তার গার্ডেন অর্গানিকস এর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারেন নকশায় এটি জ প্লটের। অর্থ্যাৎ সরকারি জশালয়। জমিটির মালিকানা জেলা পরিষদের। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ দেন। তার মূল অভিযোগ হচ্ছে জমিটি জেলা পরিষদের এবং এই জমি স্বপন কুন্ডুৃ তার নামে নামজারী করে সেটি বিক্রি করেছেন। এছাড়া ফসলি জমি অবৈধভাবে ভরাট করা হচ্ছে। এটিও বেআইনী।
অপরদিকে গত ১৫ জুলাই তারিখে আব্দুল হাকিমের হয়রানী থেকে মুক্তি পেতে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন স্বপন কুন্ডু। এতে তিনি উল্লেখ করেন, জমিটি বহুদিন থেকে আব্দুল হাকিম দখল করার পাঁয়তারা করছিলেন। সম্প্রতি জমিটি বিক্রি করে দিলে তিনি ক্ষিপ্ত হন। এরপর তিনি বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ করেন। স্বপন কুমার কুন্ডু জানান, যে জমিটি নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে তা তারা একশ বছর যাবৎ তাদের তিন পুরুষ ভোগদখল করে আসছিলেন। কিছুদিন আগে নিজেদের প্রয়োজনে জমিটি বিক্রি করেছেন। এরপরই আব্দুল হাকিম জমিটি জেলা পরিষদের বলে দাবি করেন। কিন্তু তার জমির আশেপাশে জেলা পরিষদের কোনো জমি নেই। কোনোদিন কেউ জমিটি জেলা পরিষদের বলে দাবি করেননি বলে জানান তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনি মানসিক অশান্তিতে আছেন। এই হয়রানী থেকে তিনি মুক্তি চান।
বালিয়াকান্দি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হাসিবুল হাসান জানান, ওই জমি স্বপন কুন্ডুদের। আব্দুল হাকিম যে অভিযোগ দিয়েছেন তা পুরোপুরি মিথ্যা। যাচাই বাছাই করে দেখে শুনে নিশ্চিত হয়ে নামজারী করা হয়েছে। শুধু ওই জমি নয়, আশেপাশেও জেলা পরিষদের কোনো জমি নেই। ওই জমির সাথে লাগোয়া যে জমি আছে তা সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। জেলা পরিষদের যে জায়গা সেটি ওই জমি থেকে একটু দূরে রেলগেট থেকে শুরু করে ৯৪ শতাংশ। ওই জমি মেপে ফ্লাগিং করা হয়েছে। যে জমিটি নিয়ে অভিযোগ হয়েছে ওই জমিটি স্বপন কুন্ডুরা তিন পুরুষ ধরে ভোগ করে আসছে। জমিটির নিরঙ্কুশ মালিকানা রয়েছে তাদের।
রাজবাড়ী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান একেএম শফিকুল মোর্শেদ আরুজ বলেন, ওইখানে যেভাবে কথা উঠেছে তা সঠিক নয়। ওখানে আমাদের জমি না। এসি ল্যান্ড অফিস কী করছে এটা তাদের বিষয়। ওই এলাকায় আমাদের জেলা পরিষদের ৯৪ শতাংশ জমি আছে। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ পেয়েছি। ছয় শতাংশ কম আছে। সেটি এসি ল্যান্ড অফিসকে অবগত করা হয়েছে। তাছাড়া স্বপন কুন্ডুর ওই জমির সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। এর সাথে এসি ল্যান্ড অফিসের কী আছে না আছে তা আমার জানা নেই। আমাদের জমি যেখানে আছে তা থেকে ছয় শতাংশ কম আছে। সেটি বালিয়াকান্দি ভূমি অফিসকে জানানো হয়েছে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান জানান, বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষই অভিযোগ দিয়েছে। তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।