রাজবাড়ীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আক্কাস সরদার। তার ছেলের কিনে দেওয়া স্মার্ট মোবাইল ফোনের ইউটিউবে ছাদবাগান দেখে ইচ্ছা জাগে কীভাবে ছাদ বাগান করা যায়। এরপর ইউটিউব থেকে বিভিন্ন নিয়ম অনুসরণ করে বাড়ির ছাদে শখের ছাদ বাগান শুরু করেন। এখন নিজের ছাদবাগানে আসলে দেখে নিজেই মুগ্ধ হন তিনি। তিনি রাজবাড়ী জেলা সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের কাচরন্দ গ্রামের বরাট বাজার এলাকার মৃত মো. আকের আলী সরদারের ছেলে। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত লোকোমাস্টার (ট্রেন চালক)।
তার এ শখের ছাদবাগানে আঙুর-মালটাসহ দেশি-বিদেশি প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষ হয়েছে। আঠারো শত বর্গফিটের এ ছাদের বাগানে প্রায় দেড় শতাধিক গাছ ও চারা রোপন করেছেন তিনি। বাগানের উৎপাদিত এসকল ফল খায়িয়ে স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রশংসায় ভাসছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আক্কাস সরদার ।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকো মাস্টার (ট্রেন চালক) পদের চাকরি শেষ করে দীর্ঘদিন ধরে অবসরে জীবন পার করছিলেন তিনি। করোনার সময় ইউটিউব দেখে বাড়ির ছাদবাগানে দেশি-বিদেশি প্রজাতির বিভিন্ন ফলের বাগান করার ইচ্ছা হয় তার। কিছুদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্তে পৌছান তিনি। এরপর ২০২০ সালের মাঝামাঝিতেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ফলের চারা সংগ্রহ করতে শুরু করেন তিনি। এভাবেই গড়ে ওঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আক্কাস সরদারের এ ছাদবাগান।
সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে তার বাগানে দেশি-বিদেশি প্রজাতির ফল গাছ রয়েছে। এসব ফল গাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন পেয়েছেন বিভিন্ন জাতের পেয়ারাগুলোর। তার বাগানে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ১৭ টি পেয়ারা গাছ রয়েছে। সেসব গাছের প্রায়গুলোতেই ঝুলছে পেয়ারা। জানা গেছে, এবছরে এ গাছ থেকে ফল খেয়ে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে শুভেচ্ছাস্বরুপ পাঠানোর পরও প্রায় ৪৫ কেজির বেশি পেয়ারা স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করেছেন তিনি। এ ছাড়াও তার বাগানে ব্যানানাসহ বিভিন্ন প্রজাতির আম, আপেল, জাম, পেয়ারা, আঙুর, বরই, কদবেল, জলপাই, আমড়া, বেল, মালটা, বেদানা/আনার, আনারস ইত্যাদি ফলের গাছ রয়েছে।
এছাড়াও তার বাগানে সবজির মধ্যে চাষ করেন লেবু, পুই শাক, মরিচ, ঢেড়শ, বেগুন, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দল, এলাচ, আদা, শসা, লাউ, সীম ইত্যাদি। তার ছাদবাগানের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বেশ কিছু বাহারি এবং ফুলের গাছও রয়েছে।
জানা গেছে, সারা বছর ধরেই বাগানের এসব গাছে কোনো না কোনো ফল থাকে তার ছাদে। এসব ফলেই তার পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনদের পরিবারের ফলের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। এছাড়াও তার প্রতিবেশী অনেক বেকার যুবকের কাছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন এক অনুপ্রেরণা নাম। বাগানের পাশাপাশি তিনি এসব গাছের চারা উৎপাদন করে বিক্রিও করতে শুরু করেছেন বলেও জানা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা অনিক মৃধা ও মহসিন মৃধা বলেন, আমরা তার ছাদবাগানে মাঝে মাঝেই আসি। এসে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তার থেকে চারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে এসব ফল উৎপাদনের চিন্তা করছি। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ এনে ছাদে চাষাবাদ করেছেন। বেশ কয়েক বছরে সফলতাও পেয়েছেন তিনি।
তারা আরও বলেন, তার গাছে প্রচুর মরিমাণে ফল আসে। সে ফলগুলো তিনি সকলকে সাথে নিয়ে খান। পাশাপাশি তিনি এসব ফল বিক্রিও করেছেন এবার। তার বাগান থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে এবছর আমরাও বাগান তৈরি পরিকল্পনা করছি। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারলে আশা করছি আর বেকার ঘুরে বেড়াতে হবে না। এসব ফল বিক্রি করে আমরা সাবলম্বী হতে পারবো বলে আশা করি।
ব্যবসায়ী রুহুল আমীন রিভান বলেন, আলী আক্কাস ভাই ছোটবেলা থেকে যে কাজই করেন না কেনো, তা তিনি মনোযোগ দিয়েই করেন। গাছ লাগানো তার অনেক আগেরই অভ্যাস। এটাকে তার একটি শখও বলতে পারেন। তিনি চাকরি থেকে যখন ছুটিতে আসতেন তখনই বাড়ির চারপাশে ও বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাতেন। তবে তিনি বাড়িতে নিয়মিত না থাকায়, সেগুলো পরিচর্যা করতে পারতেন না। চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটান তার ছাদের বাগানের গাছের পরিচর্যায়। তিনি গাছগুলোর প্রতি যতœশীল হয়েছেন বলেই সব গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল ধরেছে।
হঠাৎ তার ছাদবাগানে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি দেখে বেশ উচ্ছসিত হয়ে পড়েন আলী আক্কাস সরদার। তিনি বলেন, আমি আমগাছ ও পেয়ারা গাছ দিয়ে শুরু করেছিলাম। পাশাপাশি নেটের মাচা করে লাউ করেছিলাম একেবারে শুরুতে। ধীরে ধীরে বাগানের প্রতি আমার আগ্রহ বেড়েছে। এরপর আমি বিভিন্ন প্রকার গাছের চারা সংগ্রহ শুরু করি। এবছর অনেক ভালো ফলন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন অবসর সময় কাটানোর চেয়ে গাছগুলোর পরিচর্যা করি। নিজের হাতে লাগানো গাছের টাটকা ফল দেখে মন জুড়িয়ে যায়। গাছ থেকে নিজ হাতে ফল ছিরে খাওয়ার মজাই আলাদা। ছাদের বাগানে চাষ করা বিষমুক্ত ফল নিজেরা খাচ্ছি এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়িতেও পাঠাচ্ছি। আবার ফলন বেশি হওয়ায় এবার কিছু ফল বিক্রিও করেছি।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জনি খান বলেন, ছাদ বাগান পরিবেশ দূষণ কমায়। পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য উৎপাদন করে, মানসিক শান্তি ও বিনোদন দেয়। পরিবেশকে আরও সবুজ করে তোলে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় এ ছাদবাগানের মাধ্যমে। গ্রাম পর্যায়েও দিন দিন ছাদ বাগান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বরাটের আলী আক্কাস সরদারের ছাদ বাগানটি নতুনদের জন্য অনুকরণীয়। এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ছাদ বাগানে আগ্রহীদের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।