মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে আমার বুকের রক্তের দাম ২৫০ টাকা মাত্র – দেবব্রত চক্রবর্ত্তী

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩
  • ১৭২ Time View

১৯৭১ সনে আমি ১ ছেলে ও মেয়ের পিতা। মার্চে প্রথম সপ্তাহে ৭-৮ দিন আমি ও বিপ্লব চক্রবর্ত্তী এবং আমরা কয়েক জন গোয়ালন্দ মডেল হাই স্কুল রাজবাড়ী মাঠে (বর্তমানে রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ৩/৪ টা কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করি। কয়েক জন আনসার সদস্য আমাদের সঙ্গে ছিল।

মার্চ মাসের শেষের দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে পাক সেনা আজ রাতে গোয়ালন্দ হয়ে রাজবাড়ী ঢুকবে। তখন আমরা প্রায় ৪০/৫০ জন যুবক ছেলে দা-কুড়াল নিয়ে রাজবাড়ী গোয়ালন্দ সড়কে গাছের ডাল কেটে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য করে দেই। অবশ্য সেনাবাহিনী ঐ দিন আসে নাই। কয়েকদিন পর আবার ঐ একই ধরনের গুজোব ছড়িয়ে পড়ে। ঐ দিনও আমরা আরও বেশী লোকজন এক সঙ্গে মিলে অনেক গাছের ডাল কেটে রাস্তা অবরোধ করে দেই। ঐ দিন সেনাবাহিনী রাজবাড়ী ঢুকলে কত মায়ের কোলখালী হত তা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।

যুদ্ধ কতটা ভয়ংকর আর পাক সেনা বাহিনী কতটা বর্বর তা অবশ্য পরে টের পেয়েছিলাম। ওরা মানুষের মত দেখতে কিন্তু ভয়ংকর বর্বর অমানুষ। ওদের কে পশুদের সঙ্গে তুলনা করলে পশুদের অপমান করা হয়। পরবর্তীতে ২১শে এপ্রিল রাজবাড়ীতে সেনাবাহিনী আসে আমরা ভাই বোন মা সবাই বাণীরূহ ডা. অমূল্য চক্রবর্ত্তী দাদুর বাড়ীতে আশ্রয় নেই। ওখানে রাত্রে কিছু লোক এসে বলে বিহারিরা আসছে লুট করতে। যেহেতু আমি ট্রেনিং করেছিলাম আমাকে মেরে ফেলবে। মা ভাই বোন সহ পাট খেতে গিয়ে আশ্রয় নেই আমাদের মূল্যবান পোশাকাদি সোনাদানা টাকা পয়সা জমি জমার কাগজপত্র সবই পাট খেতের পাশের বাড়ীতে রেখে দেই রাত্রি বেলা। সকাল হলে আমরা বললাম কাজপত্র ও সোনাদানাগুলি দিন। তখন উনি বলেন, ওগুলো সব বিহারিরা নিয়ে গেছে।

তখনই আমি যে আনসার আমাদের ট্রেনিং দিয়েছিল তাকে বাণীবহ বাজারে পাই এবং বলি ভাই আমার এই অবস্থা তখন তিনি গিয়ে আমার জিনিসপত্রগুলো বের করে আমার হাতে দিয়ে এক কিঃমিঃ পথ পার করে দেয়। ২৩শে এপ্রিল আমরা আবার পায়ে হেটে ভবানীপুর রাজবাড়ী নিজ বাড়ীতে ফিরে আসি। এসে দেখি বাড়ী ঘর কিছুই নাই, লুটপাট এবং আগুনে পুড়ে সব ছাই। শুপারী গাছের পাতা নারকলের পাতা ও বাঁশ দিয়ে ছাউনি দিয়ে মা ও ভাই বোনদের রেখে আমি আমার স্ত্রী ও একটা বিশেষ চাহিদাসম্পূর্ন বোন বিবাহ দিয়েছিলাম তাদের খোঁজ নিতে ঘোপঘাট গ্রামে যাই। ঘোপঘাট গ্রামে বৈদ্যনাথ গোস্বামী আমার ও আমার বোনের শ্বশুর বাড়ী। ওখানে গিয়ে শুনতে পাই তারা ওখানে নাই, কুরুকদি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কুরুকদি গ্রামে তিন দিন থাকার পর ঐ গ্রামের কমিউনিস্ট নেতা শ্যামল ভট্টাচার্য চতুর্থ দিন রাতে পালিয়ে চলে যান।

পরের দিন সকালে দেখা যায় তার ধরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমরা তখন কুরুকদি গ্রামে থেকে চন্দনা নদী পার হয়ে আমার ছেলেকে কাঁধে নিয়ে আমার বোনকে সাইকেলে চড়িয়ে বিকার ঘোপঘাট গ্রামে বেলা বারটায় ফিরে আসি। আমার শ্বশুর বাড়ী ঘোপঘাট গ্রামে। আমরা ফিরে আসার মুহুর্তে ঐ কুরুকদি গ্রাম লুট হতে লাগলো। নদীর ভিতর দিয়ে সাইকেল ঠেলে আমি ভগ্নিপতি, আমার স্ত্রী শশুর ছেলে মেয়ে বোন শাশুড়ি আমার ভগ্নিপতির চার বোন সবাই একসাথে ফিরে আসি। আমার স্ত্রী আলু ভাতে ভাত রান্না করে আমি ও আমার ভগ্নিপতি প্রদীপ গোস্বামী মনা যখন ভাত খেতে বসি ঠিক সেই মূহুর্তে মিলেটারী ও রাজাকাররা পাশের গ্রাম থেকে গরু লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল মধুখালী কামারখালী রাস্তা দিয়ে।

ঘোপঘাট গ্রামের রাস্তায় রাজাকার আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় ঐ বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধা আছে। সেহেতু রাস্তা থেকে আমার শশুর বাড়ীর দুরত্ব মাত্র দুই শত হাত হবে। তাই ওখান থেকে ওরা হুংকার দিয়ে রাইফেল তাক করে আমাদের দিকে তেরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে, আমার ভগ্নিপতি প্রদীপ গোস্বামী (মনা) শ্বশুর বৈদ্যনাথ গোস্বামীকে বন্দুকের মুখে রাস্তার ঢালে নিয়ে দাঁড় করায়। আমাকে ও আমার ভগ্নিপতি প্রদীপ গোস্বামী (মনা) কে পাশাপাশি দাঁড় করায়। আমার শ্বশুর বৈদ্যনাথ গোস্বামীকে দশ হাত দূরে দাঁড় করায়। আমার পাশে রাইফেল ধারী বিহারী দাঁড়িয়ে ছিল আমার দিকে রাইফেল তাক করে। পাক বাহিনী রাস্তায় থাকে। বিহারী ৮ জন রাজাকার ছিল। ঐ রাজাকার বলে মুক্তি শেষ করে দাও। তখন ১০/১২ হাত দূরে দাঁড়ানো বিহারী রাইফেল থেকে প্রথমে আমার ভগ্নিপতিকে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে ও রাস্তার ঢালে মাটিতে পরে যায়।

আমি তখন ওর গায়ের উপর পরে যাই। যে বিহারী আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ও তখন আমাকে গুলি করে এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলতে ওখান থেকে মধুখালী বড় রাস্তায় গিয়ে উঠে তারপর চলে যায়। গুলি আমার ভগ্নিপতি প্রদীপ গোস্বামীর বুকের বাম পাশে লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায় এবং সে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আমার শ্বশুরকে রাইফেল এর মাথার বেওনেট দিয়ে আঘাত করে চলে যায়। রাইফেলের গুলি আমার পিঠের নিলদারার পাশে লেগে হাতের পাকনার হাড়সহ বেরিয়ে যায়। পাঁচ বছর অবদি আমার গা থরথর করে কাঁপত যে কোন শব্দ শুনে। এমনকি সাইকেলের টায়ার ব্লাস্ট হলেও আমি কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যেতাম।

গুলি লাগার ১০/১৫ মিনিট পর আমার জ্ঞান ফিরলে আমি আর কথা বলতে পারি না। হাত পা নাড়াবার ক্ষমতা নেই। এত পানির পিপাসা লেগেছিল মনে হচ্ছিল এক কলসি পানি যদি আমাকে কেউ দেয় তবে আমি এক নিমিষে শেষ করে দিব। আমি শোয়া অবস্থায় হাঁ করে পানির কথা মুখের ইশারায় বলি আমার ভগ্নিপতির বোন আমাকে খাদে পরে থাকা ভাঙ্গা একটি খুটির ভিতর করে বৃষ্টির পানি জমে ছিল ওই পানিটুকু আমার মুখে ঢেলে দেয় এবং আমি ওই পানিটুকু খেয়ে মহাশাস্তি অনুভব করি।

প্রথমে মৃত ভগ্নিপতিকে নিয়ে ওদের বাড়ীর বারান্দায় শুইয়ে দেয়। উত্তরে মুখ আর দক্ষিনে পা আমাকে শোয়ায়ে উত্তরে পা মাথা দেয় দক্ষিনে একই জায়গায় একই বারান্দায় অনর্গল রক্ত ঝরছে। আমার স্ত্রী তখন একখানা পরনের কাপড় ভাজ করে ওই পিঠের গর্তের মধ্যে খুব জোরে জোরে ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য একটা শাড়ির কাপড় দিয়ে ঘোড়ার পেটি যেভাবে বেঁধে দেয় সেভাবে বেঁধে দেয়। এদিকে পাকসেনা ও রাজাকার আমাকে ও ভগ্নিপতিকে মেরে ফেলেছে এই কথা কি করে পরের দিন আমার মায়ের কাছে পৌঁছালো তা মাও সঠিক করে বলতে পারেন নাই। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন রাস্তায় সবাই বলাবলি করছিল তোকে পাক বাহিনী মেরে ফেলেছে। তাই শুনে চলে এলাম তোকে দেখতে। মায়ের কান্না আর থামে না। বহু কষ্টে মা কান্না থামিয়ে রাজবাড়ী চলে এলেন।

পরের দিন ডা. আজাহার সাহেবের ওষুধের দোকানে গিয়ে আমার কথা মা বিস্তারিত বলেন তখন পড়সনরড়ঃরপশং (ওহল) ১৬টা আমার মায়ের হাতে তুলে দেন এবং বলে দেন ১২ ঘন্টা পর পর একটা করে (ওহল) দিতে হবে এবং বলে দেন নাড়ুর সুস্থতার জন্য (ওহল) গুলি দিলাম কাউকে বলবেন না। এটা জানাজানি হলে আমি আপনে আর দেবব্রত চক্রবর্ত্তী (নাডু) পাক মেলেটারীর হাত থেকে রক্ষা পাব না।

মা ঐ ওষুধগুলো পরের দিন আমার ওখানে নিজে গিয়ে পৌঁছে দেন। ৭ দিন ঐ (ওহল) দেই। আমার শ্বশুর একজন গরুর কম্পাউন্ডারকে ডেকে আনেন। সে প্রতিদিন রাত্রি ২টায় এসে আমাকে (ওহল) দেয় এবং ২০ টাকা করে নিয়ে যায়। ৭ দিন পর রাত ৩টার সময় ৮/১০ জন ডাকাত হানা দেয় আমার শ্বশুর বাড়ী দরজা কুড়াল দিয়ে ভেঙ্গে আমার শশুরকে বলে আপনার জামাই কোথায়?

ডাকাতরা দরজা ভাংতে থাকে ঐ মুহূর্তে আমি বহু কষ্টে কাঠের দ্বিতীয় তলা টিনের ছাউনির একটা টিন লাথি মেরে মেরে খুলে চালের উপর উঠে ঘরের মাটকা কামড় দিয়ে ও হাত দিয়ে ধরে থাকি। চালে উঠার সময় টিনের আঘাতেগুলি লাগার স্থানে রক্তপাত হতে থাকে। ডাকাতরা আমাকে না পেয়ে আমার শ্বশুর শাশুড়ি বোন এবং স্ত্রীকে বেধরপ পেটায়। ঐ দিন আমার শ্বশুর বাড়ীতে আর এসকে স্কুলের হেড মাষ্টার চারু ও তার স্ত্রী এক মেয়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন আমাকে না পেয়ে তখন ওরা বলে আপনার জামাইকে পেলাম না এই মেয়েটাকে নিয়ে যাব। তখন আমার শাশুড়ি ও চারু চক্রবর্ত্তীর স্ত্রী তার মেয়েকে জাপটে ধরে রাখেন মার পিট সত্বেও মেয়েটিকে তারা ছাড়েন নাই। চিৎকার চেচামেচিতে বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী এগিয়ে আসেন। ওরা তখন গ্রামবাসী আসাতে আমার শাশুড়ি ও চারু বাবুর স্ত্রীকে পুনরায় বেধরপ পিটিয়ে ভরা চলে যায়। ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি ও চারু বাবুর স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রায় ঘন্টা খানিক পানি মাথায় ঢালার পর তাদের জ্ঞান ফিরে আসে। গরুর দড়ি ও কুয়োর দড়ি মাজায় বেধে চারজন প্রতিবেশী দোতালার চালে উঠে আমাকে দড়ি ধরে আস্তে আস্তে চাল থেকে নামিয়ে দেয়। পরের দিন আমার শ্বশুরের এক বন্ধু নাম মনে নেই উনি এসে বলেন তোমাদের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিনা। তোমরা আমার বাড়ী এসো আমি তোমাদের আমার জীবন থাকতে কোন ক্ষতি হতে দেব না। তখন আমরা ঐ বাড়ীতে সেই দিনই আশ্রয় নেই।

১৯৭১ আমাদের জীবনের এক মহা বিপর্যয়ের বছর। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি এরকম বছর কারো জীবনে যেন না আসে। তিন দিন পর খবর আসে আমাদেরকে ঐ বাড়ী থেকে বের করে না দিলে ঐ বাড়ী লুট করা হবে। তখন আমরা যে যে অবস্থায় ছিলাম দুই জন তিন জন করে আলাদা আলাদাভাবে কামারখালী ঘাটে পৌঁছাই। আমার সারা গায়ে ছাই মাখা পাগলের বেশে আমার গায়ের ডানপাশে গুলি লাগার স্থান ছেড়া জামার অর্ধেক পাশ দিয়ে ঢাকা। অন্য পাশ খালি শতচ্ছিন্ন একটা প্যান্ট পড়া এ অবস্থায় কামারখালী থেকে নৌকায় নাকোল রাধানগর আমরা শশুরের এক আত্মীয়ের বাড়ী গিয়ে উঠি। দুই দিন পর উনি আমাদের বলেন রাধানগর থেকে দুইটা পাংশি (বড় নৌকা) বর্ডার পর্যন্ত যাবে। যদি আপনারা যেতে চান তাহলে যেতে পারেন। তখন আমি বলি এখানে আর থাকা ঠিক হবে না চলে যাওয়াই ভাল।

তখন আমরা সবাই পাকশীতে যাবার জন্য তৈরি হয়ে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ পাংশি নৌকার কাছে গেলে অচেনা বিধায় আমাদেরকে পাংশিতে উঠতে দেয় না। আমরা তখন সবাই মিলে পায়ে হেটে কুষ্টিয়ার পুটিমারি স্কুলে গিয়ে রাত কাটাই। রাত গভীর হলে ঐ স্কুলে কিছু লোক হানা দেয় এবং আমাদের কাছ থেকে টেনে হেচড়ে সবকিছু নিয়ে যায়। পরের দিন আমরা সকাল বেলায় বর্ডারের দিকে হাঁটতে থাকি এবং রাত্রি ৯/১০টা নাগাদ বর্ডারে গিয়ে পৌঁছাই। গভীর রাত হঠাৎ মারপিট শুরু হয়ে গেলো লুটপাট চলছে, আমার পায়ের জুতা ও টাকা পয়সা যা ছিল তাও আর রইল না। সকাল হওয়ার পর সামনে করিমপুর বর্ডার দেখতে পাই। তাড়াতাড়ি হুরমুর করে কয়েক হাজার শরণার্থীসহ আমরা সবাই চক্রবর্ত্তী সাথে বর্ডার পার হই।

সামনে আমেরিকার রেসকিউ ক্যাম্প। ওখানে নাম লিখাই। ওরা বলে আপনাদের আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। গুলি খাওয়া লোক শুনে ওদের আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো। আমার শশুর বললেন আমরা এখানে থাকবো না কয়েক ষ্টেশন পর আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে যাব ওখানেই আমরা থাকব। ওরা আমাকে কিছু ঔষধ ও আটা দিলেন। আমার ওগুলো নিয়ে ট্রেনে মদনপুর ঐ বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। আমাদের অবস্থা দেখে ঐ বাড়ীর মালিক ভালই আদর আপ্যায়ন করলেন এবং থাকার জন্য ঘর ছেড়ে দিলেন। মদনপুর আমার শ্বশুরের পূর্বপরিচিত, তাই ওখানে কয়েক দিন থাকলাম।

কয়েকদিন পর বিনা টিকিটে কোলকাতায় যাই। শরণার্থীদের কোন টিকিট লাগতো না। ষ্টেশনে টিকিট চাইলে শরণার্থী বললেই তারা কোন কথা বলতেন না চলে যেতে বলতেন। কোলকাতা হ্যারিছান রোডে শ্রীনিকেতন হোটেলে রাজবাড়ীর এমপি কাজী হেদায়েত হোসেন এর সাথে দেখা করি। তখন ওখানে উপস্থিত ছিলেন পাংশার এমপি বর্তমানে মৃত মোসলেম উদ্দিন মৃধা, স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব-কাকা বাবু কুমারেশ চক্রবর্ত্তী, পাবনার এমপির নাম মনে নেই। কাজী হেদায়েত হোসেন সাহেব বলেন তুই এখনো বেঁচে আছিস বলে আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং তার চোখ দিয়ে পানি পরতে থাকে। জড়িয়ে ধরার কারণ উনার হাতে আমার গুলি লাগার স্থানের রক্ত উনার হাতে লেগে যায় সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেড়া জামা খুলতে বলেন। জামা খুলে দেখাই।

তখন আমাকে বলেন তুই তাড়াতাড়ি বড় ডাক্তার দেখা টাকা যা লাগে আমি দেব। তখন উনি আমাকে ২৫ টাকা ধরিয়ে দেন এবং বলেন আমি কল্যানিতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তাড়াতাড়ি খুলবো। তুই আমার সাথে তাড়াতাড়ি দেখা করবি। ঐ দিনই মদনপুরে রাতে ফিরে আসি। পরের দিন মদনপুরের নাম করা ডাক্তার ডিএস গাংগুলি বাবুকে দেখাই। উনি দেখে বলেন তুমি কি কি চিকিৎসা নিয়েছো? আমি কমবায়টিক্স এর কথা বললে উনি বললেন এই সামান্য চিকিৎসাতে তুমি কি করে বেঁচে আছো। তখন ডাক্তার বাবু কিছু ক্যাপসুল এবং মলম দেন। যা আমি ব্যবহার করে অল্পদিনের মধ্যে খুব আরাম বোধ করি। এর ভিতর এক দিন কল্যাণী যাই এবং কল্যাণী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প খুঁজে বের করি ও জানতে পারি কাজী সাহেব ঐ ক্যাম্প পরিচালক এবং এনায়েত মওলা সাহেব ষ্টোর অফিসার। কাকু এনায়েত মওলা সাহেব আমাকে বলেন এক ঘন্টা আগে এলে এমপি কাজী সাহেবকে পেতি তখন আমি মদনপুরে ফিরে আসি। দুই দিন পরে আবারও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাই, ক্যাম্প প্রধান এমপি কাজী হেদায়েত হোসেন, সাহেবকে ঐ দিনেও পাইনি। মদনপুরে ফিরে আমরা সবাই মদনপুর থেকে নৈহাটি আমার মাসি বাড়ী চলে আসি। নৈহাটি থাকাবস্থায় একদিন নৈহাটি ষ্টেশনে হাঁটাহাঁটি করছি। রাজবাড়ীর কোন লোকের সাথে দেখা হবে এই আশায়। এমন সময় রাজবাড়ীর শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জু ও বদে’র সঙ্গে দেখা হয়।

অনেক দুঃখ কষ্টের কথা বলার পর আমরা ঠিক করি পরের দিন সকাল ৮টার ভিতরে কল্যাণী মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে যাব এবং ক্যাম্প কর্মকর্তা এমপি কাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করব। পরের দিন যথারীতি ক্যাম্পে যাই। যে বাসায় এমপি কাজী সাহেব থাকতেন ঐ বাসাতেই রাজবাড়ী পৌরসভার কমিশনার আঃ রশিদ সাহেবও থাকতেন। আমরা তিনজন সামনের ঘরে আলাপ করছি এমন সময় ৮/১০ জন গুন্ডা রিভলবার হাতে দরজার সামনে উপস্থিত হয় এবং আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। নইলে গুলি করে মেরে ফেলব এই কথা বলে। ওদের কথা শুনে প্রথমে বদে এগিয়ে এলে ওরা বদেরের ঘার ধরে রিভলবার পিঠে ঠেকিয়ে রাস্তায় নিয়ে দার করায়।

আমি ও সঞ্জু দুই জনে ওদের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে লেগে যাই। এমন সময় কাজী সাহেব বেরিয়ে আসেন। আমরা আরো জোর পাই এবং তুমুল তর্কাতর্কি শুরু হয় সে এক হুলুস্থুল কান্ড। তমুল চেচামেচি ও ধমকাধমকি চলাকালীন অবস্থায় রাজবাড়ী পৌরসভার কমিশনার রশিদ সাহেব ঐ বাড়ীর বাউন্ডারী টপকে সিআরপি পুলিশ অফিসে খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওরা ট্রাক ও জীবগাড়িতে প্রায় ১৫/২০ পুলিশ অফিসার ও সিপাই এসে কাজী সাহেবের সামনে দাঁড়ানো দুই জনকে ধরে ফেলে এবং চেংদোলা করে ট্রাকের উপরে তুলে নেয়। অবশিষ্ট খারা ছিল তারা এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। ঈশ্বরের কৃপায় দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে আরও এক বার রেহাই পাই। ওদের ধরে নেওয়ার পর এমপি কাজী সাহেব আমাদের ধন্যবাদ দেন। আর বলেন এখানে রোজ আসবি আমার সহযোগিতা করবি। আমরা রোজ যেতাম ও তার কথামত কাজ করে দিতাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো আমরা রাজবাড়ী আমাদের পরিবার পরিজনসহ এসে নারকেল পাতার ছাউনিতে থাকতে লাগলাম।

মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ আহম্মদের সাথে একদিন বিহারী মারা প্রত্যক্ষ করি ও তাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করি। পরে ও আমাকে একটা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেয়। ঐ সার্টিফিকেট এর ফটোকপি রাজবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা অফিসে জমা দেই। সাধারণ সম্পাদক বাকাউলের নিকট আমাকে ও বলে আপনি গুলি খাওয়া লোক আপনি এখনি সার্টিফিকেট পাবেন। ৩ দিন পর ও আমাকে একটা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেয়। ১ দিন পরে আমার বাড়ীতে এসে আমার ঐ সার্টিফিকেট ভুল আছে বলে সার্টিফিকেট নিয়ে যায় আর কোন দিনই সংশোধিত সার্টিফিকেট আমাকে দেয় নাই। যেটা কিনা আমার পাওয়ার অধিকার ছিল। প্রশাসন থেকেও কোন খোঁজ খবর নেয় নাই। জিজ্ঞেসা করলে বলে আপনার গুলি লাগার স্থান ঘোপগাট যা কিনা মধুখালীর ভিতর পরে আপনার সনদ ওখান থেকে দেবে। বহু সত্য ঘটনা লেখার ছিল কিন্তু বয়স এখন ৭৫ বছর। তাই অনেক কিছু ভুলে গেছি। যতটা মনে করতে পারলাম লিখলাম । শশুরবাড়ী ঘোপঘাট যাওয়ার অনিহার কারণে ওখানে যাওয়া হয় নাই।

২০/২৫ দিন পর কিছু পৈত্রিক জমি বিক্রি করে দুইটা টিনের ঘর করে থাকতে লাগলাম। এর মধ্যে এমপি কাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উনি খুব ভাল ব্যবহার করে আমাকে সবকিছু ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আশ্বাস দেন। এদিকে ২৫/০৯/৭২ আমার স্বামী হারা বোনের নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেট ও দুই হাজার টাকার চেক ফরিদপুর মহকুমা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট আসে। চেক নাম্বার: ঈ, ঘ-০০৬৩৮৯ তখন আমি ঐ চেক এমপি কাজী হেদায়েত হোসেন সাহেবকে দেখাই এবং বলি আমার ব্যাপারে কি করলেন? তখন তিনি বলেন তোর বোনের জামাই মারা গেছেন তাই সরকার থেকে ও কিছু অনুদান পেল। তুইও স্বীকৃতি পাবি।

রাজবাড়ীতে হঠাৎ একদিন পাংশার এমপি মোছলেম উদ্দিন মৃধা সাহেবের সাথে রাজবাড়ী কোর্ট চত্বরে দেখা। আমি তাকে আগে থেকেই চিনতাম।সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম কাকা আমার ব্যাপারে কিছুইতো হলোনা। উনি বললেন আয় আমার সাথে দেখি সামান্য কিছু করা যায় কিনা। একটা স্লিপ দিলেন এবং বললেন মহকুমা প্রশাসক সাবেরের নিকট দিবি। উনি তোকে ২৫০/- টাকা দেবেন আপাতত এইটাই রাখ। প্রকৃতি বা সৃষ্টির সেরা মনুষ্যত্বের কারনে আমার স্বীকৃতি আজও কেন পেলাম না? আমি তো বাঙ্গালী, বাংলাদেশী তাই আমি পরম প্রভুর নিকট আমার আকুতি জানিয়ে গেলাম। আমার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে! আমার হাতটি এখনো আমাকে কষ্ট দেয়! মুক্তিযুদ্ধের স্বচিত্র চোখের কোণে ভেসে উঠে, আমার কোন ঠিকানা মিলল না আজও। দেশের জন্য জীবন ও রক্ত কি দেইনি? বিবেকবান মানুষের কাছে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম। আমার জীবনের সত্য ঘটনা। এত তাড়াতাড়ি আমার জীবনের ১৯৭১ এর সব ঘটনা লিখা সম্ভব নয়। যতটুকু মনে করতে পেরেছি ততটুকুই লিখলাম ।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto kaskustoto