রাজবাড়ীবাসীর চিকিৎসার একমাত্র ভরসার জায়গা রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল। ছয় বছর আগে হাসপাতালটি একশ শয্যা থেকে আড়াইশ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০২০ সালে আড়াইশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এরপর চার দফা মেয়াদ বাড়িয়েও তা সম্পন্ন হয়নি। বর্তমানে একশ শয্যার হাসপাতালটিতে ভর্তি থাকছে দুইশ থেকে আড়াইশ রোগী। লোকবলসহ নানা কারণে প্রতিনিয়তই ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোগীদের ভোগান্তির কথা জানিয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করার জন্য তারা বারংবার গণপূর্ত বিভাগকে তাগাদা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। গণপূর্ত বিভাগ বলছে, ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী আগস্ট মাস নাগাদ পুরোপুরি শেষ হবে কাজ।
পাঁচটি উপজেলা, তিনটি পৌরসভা আর ৪২টি ইউনিয়ন নিয়ে রাজবাড়ী জেলার জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এ জেলার বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। যাদের অসুখ বিসুখে রাজবাড়ীর বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। একারণেই রাজবাড়ী সদর হাসপাতালটি তাদের ভরসাস্থল। একশ শয্যার এ হাসপাতালটিতে প্রতিদিন রোগীদের ভিড় লেগ্ইে থাকে। আন্তঃবিভাগ, বহিঃবিভাগ সবখানেই ভিড় রোগীদের। কিন্তু চিকিৎসার সব রকম সুবিধা না থাকায় একটু জটিল রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা অথবা ফরিদপুর। জেলার মানুষের চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর কথা ভেবে ২০১৮ সালের ৮সেপ্টেম্বর তারিখে হাসপাতালটি আড়াইশ শয্যায় উন্নীতকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। এজন্য হাসপাতালের পূর্ব দিকে আট তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। যেটি বাস্তবায়ন করছে রাজবাড়ী গণপূর্ত বিভাগ। ২০২০ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়।
রাজবাড়ী গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আটতলা ভবন নির্মাণের কাজ করছে জিকেবিপিএল ও এসসিএল নামে দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালের জুন মাসে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও পর পর তিনবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন মাসে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এবারেও ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি। যেকারণে আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে কাজের মেয়াদ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ৮ তলা ভবনটির সামনে রড, সিমেন্ট, বালু, ইট, পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রীর স্তুপ। কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন। ভেতরে বাইরে অনেক কাজ বাকী। লিফটের কাজ শুরুই হয়নি। বাকী রয়েছে বৈদ্যুতিক কাজও। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানেও বাকী রয়েছে অনেক কাজ। ভবনটির সামনে পানি জমে রয়েছে। নির্মাণকাজের দেখভাল করছিলেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী সাজন সাহা। তিনি জানান, হাসপাতালের কাজে তাদের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি নেই। কাজ প্রায় শেষের পথে। রং, বিদ্যুৎ, টাইলসসহ আনুষঙ্গিক কাজ চলছে। আট তলা ভবনের বেজমেন্ট ফ্লোরে থাকবে গাড়ি পার্কিং, স্টোর রুম, মরচুয়ারি, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, ফার্ণিচার রুম ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন তলায় আইসিইউ, সিসিইউ, সিটি স্ক্যান, মেমোগ্রাফির ব্যবস্থা থাকবে। পুরো আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
কাজ পরিদর্শনে আসা রাজবাড়ী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ভেতরে কিছু কাজ বাকী আছে। রাস্তা, ড্রেন নির্মাণ কাজ চলছে। কাজ সম্পন্ন হতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, করোনার কারণে কিছু দিন কাজ বন্ধ ছিল। এছাড়া প্রথমে ছয় তলা ভবন করার কথা থাকলেও পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আট তলা ভবন করার চাহিদা দেয়। একারণে নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। সময় মতো নির্মাণ সামগ্রী না পাওয়াও দেরি হওয়ার একটি কারণ ছিল। তিনি বলেন, কাজ করতে গেলে নানান রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। একটি সমস্যার সম্মুখিন হলে আর্কিটেকচারের কাছে যেতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে একটু দেরি হয়েই গেছে।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে গিয়ে দেখা যায়, বহিঃ বিভাগে শত শত রোগী চিকিৎসার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ ওষুধ নিচ্ছেন। এতটাই ভিড় হাঁটার জায়গাই নেই। আন্তঃ বিভাগে ভেতরে রোগীতে পরিপূর্ণ। হাসপাতালের বারান্দায়ও দেওয়া হয়েছে শয্যা। সেখানেই গাদাগদি করে আছেন রোগীরা। শয্যার অভাবে অনেকে শুধু ফোম পেতে রয়েছেন বারান্দার মেঝেতে। যেখান দিয়ে মানুষজন হাঁটাচলা করে।
হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে কয়েকটি ফোম পেতে রোগীদের রাখা হয়েছে। সেখানে একটি ফোমে একজন রোগী ঘুমিয়ে ছিলেন। তার মাথার কাছে হাতে স্যালাইন লাগিয়ে বসেছিলেন এক ব্যক্তি। যে কেউ ধরে নেবে তারা একই পরিবারের। রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের গোপালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মিঠু সরদার নামে ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, যে ঘুমিয়ে আছে সে তার কেউ নন। পেটে ব্যথা নিয়ে সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এখনও আসন পাননি। জায়গা না পেয়ে তার মাথার কাছে বসেছেন।
তার পাশে ছিলেন শহীদ মোল্লা নামে আরেকজন রোগী। জানালেন, ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা নিয়ে সকালে ভর্তি হয়েছেন। শয্যা পাননি। তাই বারান্দায় ফোম পেতে দিয়েছে। কিন্তু এখানে অনেক সমস্যা। বৃষ্টি হলে পানি চলে আসে। মানুষ হাঁটাচলা করলে ধুলো উড়ে আসে। মাঝে মধ্যে দুর্গন্ধও চলে আসে।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, হাসপাতালে ২৮১ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। অথচ শয্যা মাত্র একশটি। রোগী সংকুলানে তাদের প্রতিদিন হিমশিম খেতে হয়। বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বারান্দায় শয্যা পেতে ওয়ার্ড বানাতে হয়েছে। কিন্তু বারান্দা চলাফেরার জায়গা। বারান্দায় ওয়ার্ড করাতে তাদের চলাফেরায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এসএমএ হান্নান বলেন, একশ শয্যার হাসপাতালে রোগীদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আন্তঃ বিভাগ ও বহিঃ বিভাগে রোগীদের অনেক কষ্ট করতে হয়। জায়গার অভাবে রোগীদের গরমে কষ্ট করতে হয়। আড়াইশ শয্যা হাসপাতাল ভবনের কাজ শেষ হলে রোগীরা খোলামেলা স্পেস পাবে। তারাও লোকবল বেশি পাবেন। তারা রোগীদের বেশি বেশি সেবা দিতে পারবেন। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। চিকিৎসাসেবার সার্বিক চিত্রই বদলে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ভবনটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। এখনও কাজ চলছে। গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। লিফটের কাজ পুরোই বাকী আছে। কাজ সম্পন্ন করার জন্য তিনি নানাভাবে গণপূর্ত বিভাগকে বলেছেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সভায়ও বিষয়টি উত্থাপন করে বলেছিলেন আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার উপর চাপ সৃষ্টি করছে, আড়াইশ শয্যা হাসপাতালের লোকবল পাঠাতে বলছে। গণপূর্ত বিভাগ কী করছে না করছে সেটা তারা বুঝতে পারছেন না।
রাজবাড়ী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এম ইফতেখার মজিদ জানান, কিছু সমস্যার কারণে সময়মতো ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা তার।