সংগীতজগতে এমন চারটি প্রধান রীতি রয়েছে, যা সংগীতকে করেছে সমৃদ্ধ। তা হলো ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুমরি। শাস্ত্রীয় সংগীতের গায়ন পদ্ধতির চতুর্থ প্রকারটিই ‘ঠুমরি’ বা ‘ঠুংরি’। ‘ঠুমরি’ শব্দটি হিন্দি ক্রিয়াপদ ‘থুমুকনা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ নাচের গতিতে এমনভাবে হাঁটা, যাতে গোড়ালিতে ঘণ্টা বাজতে থাকে। খেয়ালকে যদি তুলনা করা হয়- যৌবনোত্তীর্ণ নরের সঙ্গে, তাহলে ঠুমরির তুলনা হবে নৃত্যরত তন্বীদেহ তরুণীর সঙ্গে! ঠুমরিতে সাধারণত, কাহারবা, যত্, দীপচন্দী, আদ্ধা, দাদরা, তাল ব্যবহার করা হয়। রাজা-বাদশাহর আমলে সংগীত সভায় বাইজি গানের ভীষণ কদর ছিল। বাইজি আর ঠুমরি যেন অবিচ্ছিন্ন এক মায়ার নাম! মেহফিলে বাইজি নাচছে অথচ তবলা, সারেঙ্গির সঙ্গে ঠুমরি শোনা যাচ্ছে না-এরকম পরিস্থিতি অকল্পনীয়।
মূলত; ঠুমরির বাণীতে, অবধী বা ব্রজ ভাষা ব্যবহৃত হয়। অন্য দিকে, এর মূল উদ্দেশ্য হলো শাস্ত্রীয় সংগীতের বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যেই কিছুটা শৈথিল্যকে প্রশ্রয় দিয়ে, শ্রোতার মনোরঞ্জন করা। যদিও ভাবের বর্ণনা আর আবেগের মিশ্রণেই ঠুমরির মূল উপজীব্য। ঠুমরি পরিবেশনে চমক সৃষ্টি করতে একজন শিল্পী ছোট ছোট তান, মুর্কি ও গিটকিরি ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। নির্দিষ্ট কিছু রাগ যেমন-ভৈরবী, পিলু, কাফি, খাম্বাজ, তিলক কামোদ ইত্যাদি রাগেই ঠুমরি গাওয়া হয়।
প্রথাগতভাবে, ঠুমরিকে দুই ভাগে মানা হয়। পূর্বী অঙ্গ এবং পাঞ্জাবি অঙ্গ। পূর্বী অঙ্গে বাণী ও সুর দুটোই একে অন্যের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়, পাঞ্জাবি অঙ্গের ঠুমরিতে সুরের প্রাধান্য বেশি থাকে। খেয়ালের মতোই এতেও তান থাকে, নানা রকমের অলংকার থাকে। কেবল এর কথা প্রধানত সৌন্দর্যের, ভালোবাসার, মান-অভিমানের। ঠুমরিতে সাহিত্য বা লিরিক খুব লম্বা হয় না। অল্প লিরিক বা শব্দকে গেয়ে বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।
খ্রিষ্টীয় ১৭শ শতকে রচিত ফকিরুল্লাহ’র রাগদর্পণ গ্রন্থে বলা আছে-বারোঁয়া এবং এই জাতীয় রাগে বিশেষ ঢঙের ঠুমরি গাওয়া হতো। প্রকৃতপক্ষে, ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে ঠুমরি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে লখনৌর নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এই গানকে তার দরবারে স্থান দেন। ফলে নবাবের আনুকূল্যে এই গান দরবারে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হয়। সে সময় দরবারের বাইজিরা রাজপুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য এই গান পরিবেশন করতেন। ফলে ঠুমরিতে শৃঙ্গাররসের আধিক্য ঘটে।
তাছাড়া, নবাব ওয়াজেদ আলি নিজেও কত্থক নাচ শিখেছিলেন এবং এই নাচের তাল আর ঘুঙুরের শব্দ দিয়ে সাজিয়ে ঠুমরি গানকে সেয়ানা আর সুন্দরী করে তুলেছিলেন। তবে নবাবের আদর্শ ছিলেন কৃষ্ণ। সে সময় তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নিয়ে উর্দুতে একটি নাটক লিখেছিলেন।
অনুরূপভাবে এই অঙ্গের অন্যান্য ঠুমরিশিল্পী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন গহরজান, বেগম আখতার, সোভা গুর্তু, প্রভা আত্রে প্রমুখ। এর বাইরে কিছু প্রখ্যাত রাগসংগীতের শিল্পী ঠুমরি গানকে সমৃদ্ধ করেন। রাগের বৈঠকি মেজাজ এবং গায়নশৈলীর পারঙ্গমতায় ভিন্নতর এদের ঠুমরি একটি বিশিষ্ট মর্যাদাপূর্ণ রূপ লাভ করেছিল।
এমনকি ঢাকায় বাইজিদের আনগোনা শুরু হয়েছিল মোগল শাসনামলে। যতদূর জানা যায়, সুবেদার ইসলাম খাঁর দরবারে যারা নাচ-গান করতেন, তাদের ‘কাঞ্চনী’ বলা হতো। উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাব নুসরাত জং, নবাব শামসুদ্দৌলা, নবাব কমরুদ্দৌলা এবং নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহর সময় বাইজিদের নাচ-গান তথা মেহফিল বৃদ্ধি পায়। এরা আহসান মঞ্জিলের মহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন, যার পরিবেশনার প্রধান ছিল ঠুমরি।
ঠুমরির জনপ্রিয়তা কলকাতা-লখনৌ সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়তেই ইংরেজরা চক্রান্ত করে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে কলকাতার মেটিয়া বুরুজ এলাকায় নির্বাসিত করেন। তার এই নির্বাসিত জীবনেও অপরিসর দরবারে সংগীতের আসর বসত। এই সূত্রে দরবারে কথক নৃত্যশিল্পী এবং ঠুমরিশিল্পীরা যোগদান করতেন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঠুমরির চটুল স্বভাবের জন্যই হয়তো অনেক ওস্তাদ ঠুমরি জানা সত্ত্বেও কিছুতেই কেবল ঠুমরি-গায়ক হিসেবে পরিচিত হতে চান না। ওদিকে আবার আসর কিন্তু শেষ করেন খেয়ালের পর ঠুমরি গেয়েই। অধিকন্তু সবচেয়ে বেশি গান যিনি লিখেছিলেন কবি নজরুল, তিনিও কেন যেন ঠুমরি কম লিখেছেন।
‘কেন বাজাও কাঁকন কনকন কত ছল-ভরে’ কি ঠুমরি? দ্বিজেন্দ্রলালও নয়। পক্ষান্তরে, একমাত্র অতুলপ্রসাদ ব্যতিক্রম। তিনি জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছিলেন লখনৌতে। সেখানে গিয়ে ঠুমরির প্রেমে খেয়াল গানে ঠুমরির রং চড়িয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো যে, গানের আরো কয়েকটা ধারা আছে, যেমন দাদরা, কাজরি, হোরি, চৈতি ইত্যাদি। যেগুলোকে আসলে ঠুমরিরই উপধারা বলা যেতে পারে। নজরুলের ‘সখি বাঁধোলো বাঁধোলো ঝুলনিয়া’ কাজরির চমৎকার দৃষ্টান্ত। আর হোরির দৃষ্টান্ত হলো নজরুলেই ‘ব্রজগোপী খেলে হোরি’।