বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ চলমান রয়েছে। ইসরায়েল-গাজা, রাশিয়া-ইউক্রেন, চীন-তাইওয়ান, এমনকি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে প্রায়ই উত্তেজনা চলছে-যা বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির ধারা বদলে দিচ্ছে। একেকটি দেশ নিজেদের রক্ষায় নানা কৌশল অবলম্বন করছে। এর মধ্যে রয়েছে গবেষণানির্ভর শিক্ষা, ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ, বিভিন্ন পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধি, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি ইত্যাদি। বর্তমানে প্রতিটি দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এসব বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এসব বিষয়ে কতটা এগিয়ে? ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য কতটা প্রস্তুত?
এর উত্তর দিতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষা সিলেবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শিশুরা মূলত মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া করে তার অর্ধেক শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে মৌলিক গবেষণা খুবই কম। গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাজেট খুবই সীমিত, আর ফলাফল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুব কম দৃশ্যমান। গবেষণা ও আত্মনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাই পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে। এর জন্য প্রয়োজন প্রথম থেকেই অনুসন্ধানমূলক প্রশ্ন শেখা, মুখস্থ না করে কীভাবে এবং কেন এর উত্তর খোঁজা, ল্যাব ও প্রজেক্ট বেইসড লার্নিং সিস্টেম তৈরি, বেসিক কোডিং শেখা এবং সর্বশেষ শিশুকে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করা। অতঃপর গবেষণা ও অ্যাসাইনমেন্ট শুধু খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে তা প্রয়োগ করা এবং দেশ প্রতিরক্ষার বেসিক ধারণা ও সাময়িক কৌশল শিক্ষা দান করা, যেটি দ্বারা তারা আত্মরক্ষা করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় মূলত গবেষণা ও উদ্ভাবনের সময়। এ সময় শিক্ষার্থী নানা বিষয় সম্পর্কে গবেষণা করার সময় পায়। তারা বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছুটে চলে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা এবং অর্থ উপার্জনের সহজ মাধ্যম খুঁজতে। ফলে তাদের মেধা এবং সারা জীবনের শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে এভাবেই। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে তারা দেশের অর্থনীতিকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি দেশ রক্ষায় বিভিন্ন অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও জোরদার করছে একইভাবে। চীনে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বাজেট রয়েছে। চীন নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র, অও সেনা প্রযুক্তি ও ন্যানোটেকনোলজিতে আত্মনির্ভর। প্রযুক্তিতে ছাত্রদের উৎসাহ দিয়ে তারা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী উৎপাদনশীল প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মৌলিক শিক্ষা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির সংমিশ্রণে তারা বিশ্বব্যাপী আইটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখানেও আবশ্যিক সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। ভারতে ওঝজঙ, উজউঙ– এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। দেশটি নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার, ট্যাংক ও রকেট তৈরি করে। ওওঞ–এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিরক্ষা গবেষণাতেও সক্রিয়। এছাড়া ইসরায়েলে স্কুলজীবন থেকে প্রযুক্তি ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা, পাশাপাশি ১৮ বছর বয়সে সবাই বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়। দেশটি নিজেই অস্ত্র, ড্রোন, সাইবার টুলস তৈরি করে। বাংলাদেশে এরূপ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষায় আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির অভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী নিয়মিত প্রশিক্ষিত হলেও আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব প্রকট। যেমন, দেশে এখনো নিজস্বভাবে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন সিস্টেম, বা দূরপাল্লার প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র নেই। আধুনিক যুদ্ধে টেকনোলজির শক্তি অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশ এখনো বিদেশনির্ভর অস্ত্র আমদানিতে আটকে আছে, যার ফলে সংকটকালে তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষা জোরদার করা কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমান যুদ্ধ সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যের যুদ্ধ। অথচ বাংলাদেশে সাইবার প্রতিরক্ষার জন্য নেই কোনও শক্তিশালী অবকাঠামো জাতীয় ডেটা সুরক্ষা, সাইবার সেনা, বা অও ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো বিষয়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ তথ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যুদ্ধকালীন আত্মরক্ষার জ্ঞান একেবারেই নেই। অনেক স্থানেই নেই জরুরি শেল্টার, নেই জরুরি পরিকল্পনা বা নাগরিক প্রশিক্ষণ। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনসচেতনতামূলক মহড়া প্রায় অনুপস্থিত। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্ক বড় সংকটে পরিণত হতে পারে। দেশে প্রতিরক্ষা বিষয়ক কোনও আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে কাজ করছে না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিক্স, ড্রোন টেকনোলজি কিংবা স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন নিয়ে গবেষণা প্রায় নেই বললেই চলে। অস্ত্র বা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সরকারি বা বেসরকারি বিনিয়োগও একেবারেই কম। ফলে গবেষণার ঘাটতি ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। তারা আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা জোটে খুব বেশি সক্রিয় নয়। ফলে বড় কোনো সংকটে পড়লে অন্য দেশের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সহায়তা পাওয়া কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও সক্রিয় হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও নিরাপত্তা জোটের সুযোগ কাজে লাগানো যায়।
যুদ্ধ কারও কাম্য নয়। তবে গবেষণাহীন শিক্ষা এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই টিকে থাকতে পারে না, যার ফলে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় আমরা কতটা দূরে অবস্থান করছি। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, যুদ্ধের জন্য শক্তি থাকা কতটা জরুরি। অতএব, নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন মৌলিক পরিবর্তনের। গবেষণাভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত প্রজন্ম গড়ার এখনই সময়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নীতিতে আধুনিক প্রতিরক্ষা কৌশল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশ রক্ষায় প্রস্তুতির বিকল্প নেই।
লেখক পরিচিতি:
রাখি আক্তার
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।
প্রকাশক : ফকীর আব্দুল জব্বার, সম্পাদক : ফকীর জাহিদুল ইসলাম, সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ ২২ নং ইয়াছিন স্কুল মার্কেট (২য় তলা), হাসপাতাল সড়ক, রাজবাড়ী সদর, রাজবাড়ী মোবাইল: 01866962662
© All rights reserved © 2022 daily Amader Rajbari