প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুল
শ.ম. রশীদ আল কামাল
ভারতবর্ষ যখন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক চেতনায় বিভক্ত তখন নজরুল এক মোহনায় দাঁড়িয়ে এক মিলনের বাঁশি বাজিয়েছেন। নানা বিভক্তির মাঝেও তাই নজরুল অবিভক্ত। অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই বলেছেন সে কথা। মানুষকে একটি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যেমন মিলনের গান গাওয়া প্রয়োজন তেমনি দ্রোহী হয়েও উঠতে হয় কখনো কখনো।
মানব প্রকৃতির প্রধান দু’টি অনুভূতি প্রেম ও দ্রোহ চেতনাকে বার বার আলোড়িত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন নজরুল। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ক্রোধ-ঘৃণা ইত্যাদি মনের অসংখ্য মৌলিক অনুভূতির মধ্যে প্রেম ও দ্রোহ বা বিদ্রোহ এতটাই শক্তিশালী যে এই চেতনার দ্বারা মানুষ নিমিষে বদলে যেতে পারে। এমনকি জীবনকেও উৎসর্গ করতে পারে।
মানব প্রকৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মানবমনে প্রেমের অবির্ভাব স্বতস্ফূর্ত। এই স্বতস্ফূর্ত প্রেম মূর্ত বিষয়ের প্রতিও হতে পারে আবার বিমূর্ত বিষয়ের প্রতিও হতে পারে। মানব প্রকৃতি সব সময় এক রকম নয়, এ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিভিন্নমুখী। কাব্য নির্মাণের প্রধান উপাদান প্রেম। এই প্রেম হতে পারে বিশেষ মানব-মানবীর জৈবিক প্রেষণাপ্রসূত হতে সামগ্রিক মানবপ্রেমকেন্দ্রিক। দেশাত্ববোধ থেকেও মানবমনে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। আবার প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেকে প্রকৃতি প্রেমিক হয়ে যান।
বাবা-মা, ভাই-বোন ও সন্তানের প্রতি ভালবাসা প্রেমেরই নামান্তর। একজন কবি এই নানারূপ প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটান তার কাব্যে। কোন কবিই প্রেমকে পরিহার করে কাব্য নির্মাণের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে পরেন না। নজরুলও পরেননি। প্রেমের মতো দ্রোহও হয়ে উঠতে পারে কাব্যের প্রধান উপাদান।
প্রেম ও দ্রোহ হলো কাজী নজরুলের কাব্য নির্মাণের প্রধান দু’টি উপাদান। নজরুল প্রেমের কবি, নজরুল বিদ্রোহের কবি, নজরুল সাম্যের কবি, নজরুল মানবতার কবি। কবি নজরুল তাঁর কাব্যে বহুমাত্রিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ভারতীয় জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেস রাজনৈতিক চেতনা রোপনের পূর্বেই ১৮৫৭ সালে সংঘটিত হয়েছিল মহাবিদ্রোহ নামে অভিহিত সিপাহী বিদ্রোহ। সুতরাং বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দেই। ১৮৮৫ সালে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের যুগে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।
ছেলেবেলাতেই পিতৃহারা হয়ে নিদারুন দারিদ্র আর অভিভাবকহীনতার কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হন। এ সময় লেটোগানের ফলে গীত রচনা ও সুর সংযোজনা করার প্রয়াসের মধ্যে নজরুল প্রতিভার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কর্মজীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন এবং সেনাবাহিনীতে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।
বিদ্রোহের জয়ধ্বনি উড়িয়ে ধূমকেতুর মতো কাজী নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলা কাব্যে। উদাত্ত কন্ঠে তিনি ঘোষণা করেছেন-
“বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর
হিমাদ্রীর।”
কেবল এ বিদ্রোহী কবিতাতেই বাংলা কবিতার আসরে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। বাংলার বিদ্রোহী কবি হলেন কবি নজরুল। বিদ্রোহী আত্মার জন্মের মূলে যে অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল তা হলো কবির প্রেম। কবি তাঁর আত্মপ্রকাশে বলে গেলেন-
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী
আর অন্য হাতে রণতুর্য”
কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
“জগতে আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম
যেখানে আমি প্রেম পাইনি- সেখানেই
আমি বিদ্রোহ করেছি”
কবি সত্য, সুন্দর ও মানবতার পূজারী। সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৮ সালে হাবিলদার নজরুল বিপ্লবী বীর বারীন ঘোষের সাথে ঘনিষ্টতার সূত্রে তিনি বাঁধা পড়লেন। স্বদেশী হাঙ্গামায় তিনি জেলে গেলেন, বেদুইন নজরুল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিলেন “ভাঙার গান” লেখার প্রেরণা পেলেন। নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অগ্নিবীণা” বেরুল ১৯২২ সালে।
প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম ওঠে নজরুলের। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে রচিত তার কবিতা “মুক্তি” এরই মধ্যে একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এবার তিনি বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছটা নিয়ে বাংলা কবিতার আসরে অবতীর্ণ হলেন। কবির উদাত্ত কণ্ঠ ও রাগ-রাগিনীর জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কীর্তন, বাউল, জারি-সারি, ভাটিয়ালীর প্রতি প্রাণের টান। সেই সাথে ফারসি গজলের মন মাতানো সুর ব্যবহারের প্রতিও ছিল তার গভীর অনুরাগ।
নজরুল চিরযৌবনের কবি। দুর্বার প্রাণ-প্রাচুর্যই যৌবনের নিশ্চিত প্রাণ-স্পন্দন।
যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল দেখলেন দেশ পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দী। ধনিক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে এক বিশাল শ্মশানভূমি।
তখন তিনি গাইলেন-
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী”
কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সচকিত আবেগ জড়িত কন্ঠে গাইলেন-
“মেনে শত বাধা টিকি হাঁচি
টিকে দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী।”
নজরুলের বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে তেমনি তার বিদ্রোহ সামাজিক অসাধ্যের বিরুদ্ধেও। তাঁর দৃষ্টিতে সকল ভেদাভেদ, অসাধ্য কৃত্রিম ও মিথ্যে। নজরুলের “অগ্নিবীণা” “বিষের বাশী” “সর্বহারা” “ফনি মনসা” প্রভৃতি কাব্যগুলোতে মূলত বিদ্রোহের সুরঝঙ্কার অনুরণিত হয়েছে। কবির চিত্তকে কোন সংকীর্ণতার পথে পরিচালিত করেনি, তার কাছে স্বদেশ ও স্বজাতিই ছিল সবচেয়ে বড় সত্য। তিনি জানতেন হিন্দু-মুসলমান একই বৃন্তে দু’টি কুসুম। তাই ১৯২৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে কবি “কান্ডারী হুশিয়ার” ধ্বনিতে বললেন-
“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষে, সন্তান মোর মার”
নজরুল কাব্য গতিশীল, নানা মাত্রিকতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে। কখনো প্রেম, কখনো মানবতা, কখনো প্রকৃতি, কখনো সাম্য, কখনো বিদ্রোহের রণতুর্য নানা উপমায় নানা পঙক্তিতে স্থান পেয়েছে। নজরুলের কাব্যসৃষ্টিতে মহাআনন্দের প্রাণ উল্লাস খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রেমিক কবি নজরুল দেশপ্রেমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ মানবপ্রেম খুঁজে বের করেন। মানবপ্রেম থেকেই দেশপ্রেম অঙ্কুরিত হয়।
ব্রিটিশ ভারতের একমাত্র কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চারণ করেছিলেন “ভারত হবে ভারতবাসীর।” এরকম দুঃসাহী উচ্চারণ তার পক্ষেই করা সম্ভব। যিনি বলতে পারেন “আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ।” ধুমকেতুর পুচ্ছটি উচ্চে তুলে ধরে নজরুল পরাধীনতার লৌহশৃঙ্খল ভেঙ্গেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি বিদ্রোহী।
আবার বিশ্বের সকল মানুষকে নজরুল একই মিলনসুরে বাঁধতে চেয়েছিলেন মানবপ্রেমের সুধা দিয়ে। তাই তার আহ্বান
“সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আমি,
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশী।”
মানুষে মানুষে ব্যবধান বা বিভেদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদী মানবতার জয়গান গেয়েছেন-
“গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান।”
নজরুল বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করে তুলেছেন, তিনি বললেন, “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান”। আবার কিশোরদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন- “আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনার ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ।” বলে তারুণ্যকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাই কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি। প্রেমও দ্রোহের মাধ্যমে নজরুল গণমানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। মূলতঃ নজরুলের দ্রোহ চেতনা তাঁকে তুলে ধরেছে খ্যাতির উচ্চ শিখরে। নজরুলের গানের বিপ্লবী চেতনা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দারুন উজ্জীবিত করেছিল।
প্রিয় কবির সৃজনশীল সৃষ্টি আজও আমাদের প্রাণে শক্তি জোগায়। আমাদের অনুপ্রাণিত করে। নজরুল চিরদিনের কবি। প্রেম আর দ্রোহ এক হৃদয়ে তিনি লালন করেছেন চিরকাল। শিখিয়ে দিয়ে গেছেন যে মন প্রতিবাদের আগুন জ্বালে, প্রেম সে মনেরই অলংকার। মানবপ্রেম তথা মানুষের প্রতি ভালোবাসা নজরুল কাব্যের প্রধান উপাদান। তাইতো তিনি বলেছেন, “এসেছিলাম এই বিশ্ব চরাচরে ক্ষণিক অতিথি বেশে রেখে গেলাম বুকের পাঁজর ভেঙে
জীবনের গান- মানুষকে ভালোবেসে”।
পরিশেষে,
“সর্বজীবে পূণ্যমিলন হোক অতল মৈত্রী,
বিকশিত হোক কবি, তোমার মহাপ্রেম
বাজাও বাঁশের বাঁশরী।”
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ডা. আবুল হোসেন কলেজ, রাজবাড়ী,